কী মুরতি

শহরের অনেকগুলি প্রধান রাস্তা প্রায় অবরুদ্ধ হইল, তাহার মধ্যেই পথে পথে জ্যাম, কোণে কোণে ব্যারিকেড পার হইয়া সকলে রেড রোড অভিমুখে ছুটিলেন, কেহ ভিড় ঠেলিয়া জাঁকজমকের কিয়ৎ চলদ্দৃশ্য দেখিতে পাইলেন, কেহ ভিড়ের প্রাবল্যে নিজেদেরই হারাইয়া ফেলিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৩০
Share:

বাঙালি সব হারাইয়াছে, কেবল মরিতে মরিতেও যাহা সে প্রাণপণ আঁকড়াইয়া রাখিয়াছে, তাহার নাম রসবোধ। সুতরাং মুখ্যমন্ত্রীর সাধের কার্নিভাল ও মহানগরীর অসীম দুর্গতির মুখে দাঁড়াইয়া বাঙালির দুর্দান্ত মন্তব্য, সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়া আজিকার পশ্চিমবঙ্গ বিসর্জনকে সংস্কৃতি বানাইয়াছে! এই নূতন সংস্কৃতিমতে এই বার দুর্গাপূজার বিসর্জনকে অযথা প্রলম্বিত করিয়া লক্ষ্মীপূজার ঠিক আগের দিন ‘কার্নিভাল’-এর আয়োজন হইল। শহরের অনেকগুলি প্রধান রাস্তা প্রায় অবরুদ্ধ হইল, তাহার মধ্যেই পথে পথে জ্যাম, কোণে কোণে ব্যারিকেড পার হইয়া সকলে রেড রোড অভিমুখে ছুটিলেন, কেহ ভিড় ঠেলিয়া জাঁকজমকের কিয়ৎ চলদ্দৃশ্য দেখিতে পাইলেন, কেহ ভিড়ের প্রাবল্যে নিজেদেরই হারাইয়া ফেলিলেন। সব মিলাইয়া, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাহা চাহিয়াছিলেন তাহাই ঘটিল। কলিকাতার কার্নিভাল এখন একটি ‘ঘটনা’য় পর্যবসিত। মুখে মুখে প্রশ্ন: কলিকাতার শোভাযাত্রা কি ব্রাজ়িলের রিয়োর কার্নিভালের সহিত তুলনীয়? অর্থাৎ কলিকাতার ইকো পার্কে যেমন মিশরের পিরামিড হইতে চিনের প্রাচীর, কিংবা আগরার তাজমহল অতি সংক্ষিপ্তাকারে পশ্চিমবঙ্গবাসীর মনোহরণের জন্য একত্র করা হইয়াছে, এবং মুখ্যমন্ত্রী-বিরচিত শব্দবন্ধ ‘বিশ্ববাংলা’র বিজ্ঞাপন হিসাবে তাহারা বিরাজ করিতেছে, দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনও সেই তালিকায় নাম লিখাইয়াছে। ‘বিশ্ববাংলা’র উপযুক্ত হইতে হইবে, তাই বিসর্জন শোভাযাত্রা ‘কার্নিভাল’-এ রূপান্তরিত হইয়াছে।

Advertisement

যাঁহারা প্রশ্ন তুলিতেছেন, ধর্মীয় উৎসবের জন্য সরকারি অর্থের এই অপচয় কেন, রাস্তা জুড়িয়া লক্ষ লক্ষ চেয়ার, প্রাসাদোপম মঞ্চ, সুদীর্ঘ সুসজ্জিত শামিয়ানার বাড়াবাড়ি কেন— তাঁহারা সংস্কৃতির কিছুই বোঝেন না, সংশয়। এবং রাজনীতিরও কিছু বোঝেন না, নিশ্চিত। আপাত ভাবে ধর্মকে সংস্কৃতি করিয়া তুলিবার কাজটি সরকার এখন নিজ হস্তে লহিয়াছে। আপাত-র নীচে নিহিত কারণ: জনমনোরঞ্জনের ইহা সহজতর পথ। সরকারি অর্থে শিল্প, বাণিজ্য, কর্মসংস্থান করিবার অপেক্ষা বিনোদনের আয়োজন অনেক সহজসাধ্য ও দ্রুতফলদায়ী। জনমনের রঞ্জনপন্থাকে অতিসরল করিয়া লইবার এই প্রয়াসের মধ্যে আছে রাজনীতির অব্যর্থ রসায়ন। পূজা কমিটিগুলির জন্য ২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা বা কার্নিভালে ৭২টি সেরা প্রতিমাদর্শনের বন্দোবস্ত করা, কোনওটিই অহেতুক কিংবা অনাবশ্যক নহে।

হেতু ও আবশ্যকতার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর প্রীতি অর্জনই প্রধান। পাড়ায় পাড়ায় শোভিত হইতেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের করজোড় স্বাগতবার্তা। কার্নিভালে চলিতেছে মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদজ্ঞাপনের আসর। ‌নৃত্যগীত চলিতেছে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারটির ঠিক সামনে, যেখানে তাঁহার ও সরকারি কর্তাব্যক্তিদের পদতলে সারে সারে আসীন বিনোদনজগতের শিল্পীগণ। পরের বৎসর কার্নিভালকে মাথায় রাখিয়া যে এখন হইতেই পূজা কমিটিগুলি নির্বাচিত ও আমন্ত্রিত হইতে সচেষ্ট হইবে, শিল্পীরা যে কৃপাধন্য হইবার প্রতিযোগিতায় নামিবেন, তাহাতে সংশয় থাকে না। রাজ্যের সামগ্রিক চরিত্রটি এই কার্নিভালের মধ্যেই বিধৃত। আনন্দবিনোদন ও কৃপাবিতরণের প্রচণ্ড উতরোল তাহার পিছন দিকের সঙ্কটময়, চলচ্ছক্তিহীন, আশঙ্কাব্যাকুল সমাজটিকে ঢাকিতে ব্যস্ত।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন