মানবাধিকারের মূল্য

যে মামলাটির প্রেক্ষিতে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় মানবাধিকার কমিশনের মর্যাদা স্মরণ করাইলেন রাজ্যকে, তাহার মধ্যেও এই বিলম্ব করিবার প্রচেষ্টা পরিষ্কার। ২০১২ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যঙ্গচিত্র সোশ্যাল মিডিয়াতে দিবার অভিযোগে অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে গ্রেফতার করিয়াছিল পুলিশ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

পশ্চিমবঙ্গে মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠার তেইশ বৎসর পূর্ণ হইতে চলিয়াছে। তাহার পূর্বে কমিশনের প্রয়োজন লইয়াই প্রশ্ন উঠিল। প্রশ্ন তুলিল কলিকাতা হাইকোর্ট। বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি আইনজীবীকে প্রশ্ন করেন, যদি মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ সরকার মানিতে প্রস্তুত না থাকে, তাহা হইলে কমিশন থাকিবার প্রয়োজন কী? কমিশন সুপারিশ করিলে রাজ্য চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে পারে কি? বিচারপতির কথাটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। মানবাধিকার সুরক্ষা (১৯৯৩) আইন অনুসারে মানবাধিকার কমিশনের শাস্তি দিবার ক্ষমতা নাই। কিছু ক্ষেত্রে তদন্ত করিবার, এবং সরকারকে সুপারিশ করিবার মধ্যেই তাহার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। বিচারপ্রার্থী ব্যক্তি বা তাহার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিবার সুপারিশ করিতে পারে কমিশন, দোষী আধিকারিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করিবার, তাহাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করিবার সুপারিশও করিতে পারে। সেই সঙ্গে মানবাধিকার সুরক্ষার লক্ষ্যে সরকারকে কোনও কাজ করিবার, বা কোনও কাজ হইতে বিরত হইবার সুপারিশ করিতে পারে। এই সকল সুপারিশ মানিবার বাধ্যবাধকতা না থাকিলেও সকল সুপারিশ উপেক্ষা করিবারও কথা নয়। অথচ নিয়মিত ভাবে রাজ্য সরকারের তরফে এমন উপেক্ষা দেখা যায়। কখনও নাগরিককে ক্ষতিপূরণটিই দেওয়া হয় না। কখনও দোষী আধিকারিকের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ অগ্রাহ্য করা হয়। ছয় সপ্তাহের সময়সীমা বাঁধিয়াছে আইন, কিন্তু রাজ্যগুলি তাহা অবাধে লঙ্ঘন করে। সময় নষ্ট করিবার এক পরিচিত উপায়, কমিশনের সুপারিশের বিরুদ্ধে আদালতে একের পর এক আবেদন করিয়া অকারণ কালক্ষেপ।

Advertisement

যে মামলাটির প্রেক্ষিতে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় মানবাধিকার কমিশনের মর্যাদা স্মরণ করাইলেন রাজ্যকে, তাহার মধ্যেও এই বিলম্ব করিবার প্রচেষ্টা পরিষ্কার। ২০১২ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যঙ্গচিত্র সোশ্যাল মিডিয়াতে দিবার অভিযোগে অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে গ্রেফতার করিয়াছিল পুলিশ। মানবাধিকার কমিশন তাঁহাকে ক্ষতিপূরণ দিবার সুপারিশ করে। রাজ্য সেই সুপারিশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হইলে ২০১৫ সালে ফের ক্ষতিপূরণ দিবার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। অতঃপর রাজ্য ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করে। প্রশ্ন ওঠে, রাজকোষ হইতে খরচ করিয়া এমন দীর্ঘ সময় ধরিয়া মামলা চালাইবার কী প্রয়োজন? যুক্তিই বা কী? মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশের প্রতি অসম্মান দেখাইয়া কাহার সম্মান রক্ষা করিতে চাহেন রাজ্য সরকারের আইনজীবী? বিশেষত যে ঘটনায় রাজ্য সরকারের আচরণ স্পষ্টতই ন্যক্কারজনক ছিল? মানবাধিকার এক মৌলিক অধিকার, গোটা বিশ্বে তাহা অবিসংবাদিত। কিন্তু ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, তথা রাজ্য কমিশনগুলিও প্রতিনিয়ত উপেক্ষিত, অপমানিত হইতেছে।

মানবাধিকার সুরক্ষা আইন অনুসারে কমিশনের সুপারিশ অগ্রাহ্য করা হইলে কমিশন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হইতে পারে। শীর্ষ আদালতের নির্দেশ মানিতে রাজ্য ও কেন্দ্র, সকল সরকার বাধ্য। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনের সেই সুযোগ কয়েক বার কাজে লাগাইলেও রাজ্য কমিশনগুলি নীরবে উপেক্ষা সহিয়া যায়। মানবাধিকার সংগঠনগুলির অভিযোগ, এই মানসিকতার বশবর্তী হইয়া সরকার সরকার-ঘনিষ্ঠ বিচারপতি, পুলিশ, আমলাদেরই কমিশনে নিয়োগ করিয়া থাকে। বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রশ্ন করিয়াছেন, অবসরের পর কিছু ব্যক্তিকে বাড়তি সুযোগ দিবার জন্যই কি তাঁহাদের মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়? রাজ্য সরকার যদি বধির ও বুদ্ধিহীন না হইয়া থাকে, তবে বুঝিবে যে ইহা প্রশ্ন নহে। কঠিন তিরস্কার। মানবাধিকার বস্তুটিকে তীব্র অবহেলার ফলেই এই তিরস্কার জুটিল।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন