নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
ব্যবসাই হল গুজরাতের স্নায়ুতন্ত্র। গুজরাতিরা বলেন, ধান্দা। আমাদের বাঙালি মূল্যবোধে ‘ধান্দা’ মানে খারাপ ব্যাপার। নেতিবাচক উপাদান আছে শব্দটিতে। ওখানে তা নয়।
এই কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে যদি আঘাত এসে লাগে? তা হলে রাজ্যটির প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক। তাই এ বার গুজরাত ভোটের সময় অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই যখন জাতপাতের সমীকরণ নিয়ে ব্যস্ত তখন রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিকূলতা এক মস্ত বড় শঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে শাসক দলের। এমনকী, এই জাতপাতের বিষয়টির সঙ্গেও আর্থিক অসন্তোষের এক গভীর সম্পর্ক আছে।
সুধী পাঠক, আজকের শাহি সমাচারে জাতপাত নয়, আমি রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
বর্ধিত বেকারি এবং সার্বিক আর্থিক অবনয়ন বড় ঘটনা হয়ে উঠেছে। একটা সময় ছিল যখন গুজরাতে বিজেপির সবচেয়ে বড় স্লোগান ছিল, ‘হু বিকাশ ছু, হু ছু গুজরাত।’ আমিই বিকাশ, আমিই গুজরাত। গুজরাত মডেল, গুজরাত মডেল শুনতে শুনতে আমাদের কান খুবই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। গত চার বছর ধরে গুজরাত রাজ্যটিতে শুধুই ভারী বড় শিল্পের কথা বলেছে মোদীর বিজেপি। কিন্তু ২০১৪-’১৫ সালে শতকরা ৭.৭ ভাগে বৃদ্ধির পৌঁছনো গুজরাতের জন্য ছিল দুঃসংবাদ। বিমুদ্রাকরণ এবং জিএসটি’র প্রভাব এ রাজ্যের কী শহরে কী গ্রামে কতখানি তীব্র সে তো এত দিনে পাঠক আপনি বুঝেই গেছেন। তা না হলে যে নরেন্দ্র মোদীকে বলা হত ‘মি. নো রোল ব্যাক’, পিছু হঠা যার ডিএনএ-তে নেই, সেই মোদীর সরকার যে ভাবে জিএসটি-র বিষয়ে নিজেদেরই গৃহীত সিদ্ধান্তকে লঘু করে দিল শুধু গুজরাত নির্বাচনের জন্য, সেটা দেখেও বুঝে নেওয়া যায় অনেক কিছু।
এখন সুতি বস্ত্রশিল্পের দুরবস্থা থেকে বিজেপি সরকার নতুন নীতি গ্রহণ করে সাবেকি ছোট ছোট শিল্পে নিয়োগের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার নতুন নীতি ঘোষণা করেছে। এই নীতি এই বিনিয়োগ নাকি এক লাখ নতুন চাকরি তৈরি করবে রাজ্য। বস্ত্র শিল্পে উৎপাদন ইউনিট আছে যাদের তাদের মধ্যে মহিলাদের জন্য অতিরিক্ত ৪,০০০ টাকা এবং পুরুষদের জন্য অতিরিক্ত ৩,২০০ টাকা আয়ের ব্যবস্থা হবে। অতিরিক্ত ১৬টি গুজরাত শিল্প উন্নয়ন নিগম ঘোষণা করা হল ভোটের মুখে। এগুলি ১৫ হাজার ক্ষুদ্র (স্মল), মাঝারি, অতি ক্ষুদ্র (মাইক্রো) উদ্যোগীদের জন্য অতিরিক্ত এক লাখ কাজের ব্যবস্থা করবে। এত দিন ধরে গুজরাত শিল্প উন্নয়ন নিগমের মাধ্যমে বড় শিল্প গঠনের কথা বলা হলেও এত দিনে তারা তাদের ঘোষিত লক্ষ্যের অর্ধেকও পূরণ করতে পারেনি। রাজ্যে উৎপাদন শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ কমে গেছে।
সিঙ্গুরের সেই ন্যানো কারখানা। ফাইল চিত্র।
কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান ব্যুরো হল গুজরাত সরকারের অধীনে একটি সংস্থা। ২০১৫-’১৬ সালে কর্মসংস্থান ও বেকারি নিয়ে তাদের একটা সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এই সংস্থার রিপোর্টে বলা হচ্ছে বেকারিতে বিভিন্ন রাজ্যে শতকরা ৯ ভাগ। অবশ্য ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত অনুপমা কাটাকানের প্রতিবেদন থেকে জানলাম, অমদাবাদের এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ আবার ভিন্ন পরিসংখ্যান দিচ্ছে। রাজ্যের শ্রম দফতর বলছে, রাজ্যে ২.৪৫ লাখ যুবক বেকার। ২০১৫ সালের মার্চ মাসের পরিসংখ্যান এটি। অমদাবাদ জেলায় এই সংখ্যা ৮৮,৭৫০।
পরিসংখ্যান নিয়েও বিতর্ক আছে। অনেক অর্থনীতিবিদ বলছেন, এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জেও সমস্ত বেকার নথিভুক্ত নন। সর্বত্রই এটা হয় আমি জানি। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গও ব্যতিক্রম নয়।
জেএনইউয়ের সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ রিজিওনাল ডেভেলপমেন্টের অধ্যাপক অতুল সুদ গুজরাতের আর্থিক বিকাশ নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। তিনি বলছেন, গুজরাতে নানা আর্থ-সামাজিক ‘starta’ আছে। শ্রম-বাজারের সঙ্কটই একমাত্র সমস্যা নয়। অনেক স্তর আছে। অনেক ছোট পুঁজিপতি রাজ্যের সম্পদে বৃহত্তর দখল নিতে আগ্রহী। তাই গুজরাতে আর্থিক অসাম্যও খুব তীব্র।
গুজরাতে বুলেট ট্রেনের কথা বলা হচ্ছে কিন্তু আমজনতার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ন্যায় ও শান্তির সূচক এই হাই স্পিড লেনের বৃদ্ধির আওয়াজে হারিয়ে গেছে।
মোদী এবং বিজেপি’র শাসনে একটা প্রজন্ম গড়ে উঠেছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য থেকেই জানা যাচ্ছে ২১ লাখ ভোটার এ রাজ্যের প্রথম ভোটার। এই প্রজন্মই আজ বেকারি ও কর্মহীনতার শিকার। এরা সবাই ধনী-ব্যবসায়ী পুত্র, এমনটা ভাবার কারণ নেই।
২০০২ সালে মোদী ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যে শিল্পায়ন এবং উন্নয়নের ঝ়়ড় তুলতে চেয়েছেন। আমি নিজে মোদী আয়োজিত ভাইব্রান্ট গুজরাত সম্মেলন নিয়মিত দেখতে যেতাম। সাংবাদিক হিসেবে কভার করেছি। ২০০৩ সালে মাত্র ৫০০ জনকে নিয়ে তিনি এই সম্মেলন শুরু করেন। ২০১৭ সালে এই সম্মেলন হয়ে যায় চার দিনব্যাপী। হাজির হন ৫৫ হাজার মানুষ। ২০০৩ সালে গুজরাত সরকার ৭৬টি মৌ স্বাক্ষর করে, ৬৬ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি ছিল তাতে। ২০১৭ সালে ২৫,৫৭৮টি মৌ স্বাক্ষর হয়েছে, কিন্তু মোট কত টাকার বিনিয়োগ হবে তা জানানো হয়নি। ৯২০ বর্গকিলোমিটার নিয়ে ঢোলেরা বিশেষ বিনিয়োগ ক্ষেত্র (স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট রিজিয়ন) গড়ে তোলেন মোদী। আমি এই এলাকা ঘুরে দেখেছি। ঊষর এলাকা। তাই এখানে এসইজেড করতে কোনও অসুবিধা নেই পশ্চিমবঙ্গের মতো।
গুজরাতের বিশেষ বিনিয়োগ ক্ষেত্র ঢোলেরা। ফাইল চিত্র।
কিন্তু এ বারের নির্বাচনে মোদী উন্নয়ন ও বিকাশের তাস ব্যবহার করছেন কোথায়? তিনি গুজরাতি আঞ্চলিক তাস ব্যবহার করেছেন। অমিত শাহ’র পছন্দের মেরুকরণের রাজনীতি হিন্দুত্ব-পাতিদার-তফসিলি ও সংখ্যালঘু ভোট রাজনীতিকে দূরে সরাতে তৎপর।
ভোটে কী হবে সে এক ভিন্ন বিষয়। মৌ স্বাক্ষর মানেই যে শিল্পায়ন নয় সে তো পশ্চিমবঙ্গবাসীও ভাল জানেন।
জ্যোতি বসু-সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের শিল্পায়নের ফানুস আমরা দেখেছি। আবার সিঙ্গুরে টাটার কারখানা যখন হল না তখন ন্যানো গুজরাতে গেলে আমি মোদীকে তার জন্য সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। কিন্তু আজ যখন গুজরাতের আর্থিক হকিকতের পূর্ণাঙ্গ ছবিটি দেখছি তখন মনে হচ্ছে, তা হলে এই গুজরাত মডেলটি কী? আর এই আত্মশ্লাঘা কেন?