ফকিরচন্দ্র রায়ের মূর্তি। গলসিতে। ছবি: কাজল মির্জা
পরাধীন ভারতের মুক্তির বাসনায় বর্ধমান জেলার যে সমস্ত বিপ্লবী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম পূর্ব বর্ধমানের গলসি থানা অঞ্চলের শিড়রাই গ্রামের ফকিরচন্দ্র রায়।
বাংলা ১৩১২ সালের ৩১ কার্তিক (১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ) ফকিরচন্দ্র রায়ের জন্ম। পিতা সুরেন্দ্রনাথ রায়, মাতা অভয়া দেবী। ফকিরচন্দ্রের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় মাতুলালয় বাঁকুড়া জেলার মেজিয়া থানা এলাকার তেলেণ্ডা গ্রামে। এর পরে তিনি রামগোপালপুর স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বর্ধমান রাজ কলেজে ভর্তি হন। এই সময় টাউনহলে এক সভায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের দেশাত্মবোধক উদ্দীপনাময় বক্তৃতা শুনে তিনি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হন।
পড়াশোনায় আর মন বসল না। কলেজে নাম এক বার কেটে গেল। আবার ভর্তি হলেন। আর অন্য দিকে ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে গড়ে উঠতে থাকে ফকিরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
সেই সময় ফকিরচন্দ্র সংস্পর্শে আসেন বর্ধমানের স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয় বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের—যেমন খাদি প্রতিষ্ঠানের মন্মথ সেন, সাধনা প্রেসের দুর্লভ মিশ্র, বলাই দেব শর্মা, বসন্ত মৈত্র প্রমুখ। সংগঠনের কাজে নিয়মিত যাতায়াত করতে লাগলেন রানিগঞ্জ, গুসকরা, কলকাতা, বাঁকুড়ায়। ইতিহাসবিদদের একাংশের দাবি, সেই সময় বিপ্লবীদের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে চিঠির আদানপ্রদান এবং পুলিশের গতিবিধির উপরে নজরদারির দায়িত্ব ছিল ফকিরবাবুর।
ফকিরচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে বর্ধমানে প্রথম রাজনৈতিক ছাত্র সম্মেলন ও যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন তৎকালীন বর্ধমানের মহারাজ উদয়চাঁদ মহাতাব ও সভাপতিত্ব করেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত।
এই সম্মেলনের সৌজন্যে ফকিরচন্দ্র রায় লক্ষ করলেন জাতীয় আন্দোলনের দু’টি ভিন্ন ধারাকে। এক দিকে ছিল মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন। বর্ধমানে ওই আন্দোলনের কেন্দ্রে সে সময় গলসির সাটিনন্দি গ্রামের যাদবেন্দ্র পাঁজা। অন্য দিকে, বিভিন্ন গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের হিংসাত্মক কার্যকলাপ, বর্ধমানে যার নেতৃত্বে ছিলেন ফকিরচন্দ্র নিজেই। এই সময় চান্না গ্রামে অগ্নিযুগের বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তথা নিরালম্ব স্বামীর আশ্রমে ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে আলোচনায় তিনি গভীর ভাবে প্রভাবিত হন।
১৯২৯-৩০ সালে লাহৌরে ‘জাতীয় নিখিল ভারতীয় যুব সমিতি’ ও ‘নিখিল ভারতীয় ছাত্র সমিতি’ গঠনের জন্য আয়োজিত সম্মেলনে বাংলার প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ফকিরচন্দ্র রায়। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ভগত সিংহের পিতা কিসেন সিংহ এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিপ্লবী নেতাদের। সম্মেলন থেকে ফেরার পথে ফকিরচন্দ্রের দেখা হয় জওহরলাল নেহরুর সঙ্গেও।
১৯৩০ সালের অগস্ট মাসে ফকিরবাবুকে ব্রিটিশ পুলিশ বর্ধমানের ব্রাহ্মমন্দির থেকে গভীর রাতে গ্রেফতার করে। কলকাতার ডালহৌসি স্ক্যোয়ারে ব্রিটিশ পুলিশ-কর্তা স্যার চার্লস টেগার্টের উপরে যে আক্রমণ হয়েছিল, সেই আক্রমণকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ পুলিশ এক ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। বর্ধমান জেল থেকে ফকিরচন্দ্র রায়কে প্রথমে পাঠানো হয় নিতপুর জেলে। এই বিপ্লবীকে প্রথম দফায় একটানা আট বছর বর্ধমান, নিতপুর, বগুড়া, বহরমপুর ও বাংলার বাইরে রাজ্যের নানা কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছিল।
বিপ্লবী ফকিরচন্দ্র রায়ের এমনই সহজ, সরল মানসিকতা ছিল যে তিনি যে কারাগারেই বদলি হয়েছেন, সেখানকার কার্যত মানুষজনদের আপন করে নিতে পেরেছেন। নিতপুর জেলের সকল কর্মচারী থেকে বন্দি—সবার সঙ্গে তাঁর এক রকম অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তেমনই আবার বহরমপুর জেলের কড়াকড়ি নিয়মের মধ্যে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক সুন্দর সাংস্কৃতিক পরিবেশ। সেখানে বন্দি অন্য বিপ্লবীদের মধ্যে ছিলেন কানাইলাল দে, হৃষিকেশ দত্ত, দীনেশ বন্দোপাধ্যায়, সুধীরচন্দ্র ঘোষ, গায়ক হেমেন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখ। এঁরা নিয়মিত দুপুরবেলায় আয়োজন করতেন করতেন পাঠ চক্রের। এ ছাড়া, সঙ্গীত চর্চা ও সাহিত্য আলোচনাও হত। ফকিরচন্দ্র রায় তাঁর আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিকায়’ এই বন্দিজীবনে কাটানো হাসি-কান্নার দিনগুলির কথা উল্লেখ করে গিয়েছেন।
ভারতের পরাধীনতার বেদনা তাঁর হৃদয়কে করে তুলেছিল ক্ষতবিক্ষত। সে বেদনা থেকেই তিনি বিপ্লব-মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন। জীবনের অমূল্য দিনগুলি কাটিয়েছেন জেলখানার চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ অবস্থায়। তবে ইংরেজ পুলিশের নির্যাতন তাঁর প্রাণখোলা হৃদয়কে কখনও
দমাতে পারেনি।
লেখক আবুঝহাটির টেরাপুর পল্লিমঙ্গল হাই মাদ্রাসার শিক্ষক