সিবিআই আজও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অস্ত্র? তা হলে আর উন্নতি কী হল

আডবাণীকে বলেছিলাম, ছ’বছর ক্ষমতায় থেকেও আপনি পারেননি সিবিআইকে চার্জশিট প্রত্যাহার করাতে। কিন্তু মোদী জমানায় সিবিআইয়ের এত তদন্ত হচ্ছে, কোনও গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিরুদ্ধে কোনও তদন্তই হল না কেন? কোনও চার্জশিট হয়নি। এ-ও এক রহস্য।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৮ ০১:০৭
Share:

মৃত্যুসংবাদটা পেয়েছেন? গলা খাদে নামিয়ে নাটকীয় ভাবে আমাদের রবিবারের আড্ডায় প্রবেশ করলেন সিধুদা। ইস্ট ইন্ডিয়া ওষুধ কোম্পানির প্রবীণ উপদেষ্টা। সমস্বরে জানতে চাওয়া হল, কে? কে মারা গেলেন? এ বার নিজের আসন গ্রহণ করে সিধুদা মুচকি হেসে বললেন, সিবিআই। কেন তোমরা খবর পাওনি সিবিআই মারা গেল?

Advertisement

আমি বললাম, কথাটা মন্দ বলেননি। সিবিআইয়ের জন্ম ১৯৬৩। ৫৫ বছর বয়স এই সংস্থার। তিল তিল করে সাংবিধানিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় হয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর শাসনে সংস্থার শবদেহ এখন লাশকাটা ঘরে। ময়না তদন্ত শুরু হয়েছে। প্রদীপবাবু বিজেপি-সমর্থক, তিনি বললেন, বটে বটে, এটা কিন্তু বদ রসিকতা! নরেন্দ্র মোদী কী করবেন শুনি? সিবিআইয়ের নম্বর ওয়ান আর নম্বর টু, দুই অফিসার নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত। সিবিআই এক সাংবিধানিক স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। এখানে নরেন্দ্র মোদীর অপরাধ কোথায়? বরং বলব, এই ঝগড়া দেখে চিফ ভিজিল্যান্স কমিশনারের সুপারিশ মেনে দু’জনকেই ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর করা, এটা মন্দ কী?

চিত্তরঞ্জন ভবনের কফি লাউঞ্জে রবিবারের সাপ্তাহিক আড্ডাটা ছিল এ রকমই— বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান-টাইপের। মাঝে মাঝেই গরম কফি আর চা দিয়ে যাচ্ছে নেপালের নেত্র। চিত্তরঞ্জন ভবনের গ্রন্থাগারিক ধরদা বললেন, এটা পার্লামেন্ট না কি যে সব কথা মেপেজুপে বলতে হবে? মুখে যা-ই বলো না কেন, আসলে সিবিআই তো প্রভুর পদতলের দাসানুদাস। ভাস্করদা টেবিল ঠুকে বললেন, ২০১৩ সালে মোদী বলেছিলেন, সিবিআই মানে হল কংগ্রেস ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। আর আজ কংগ্রেস বলছে, ক্যাপটিভ (বন্দি) ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। মমতা বলেছেন, বিবিআই, বিজেপি ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী দীপকদা বললেন, টুজি দুর্নীতি মামলার সময় মনমোহন জমানায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির স্মরণীয় মন্তব্য সিবিআই এক খাঁচায় বন্দি তোতাপাখি। তার মানে মূল অভিযোগ হল, দুর্নীতি ও আর্থিক কেলেঙ্কারি তদন্তে সব যুগেই সিবিআই এক রাজনৈতিক অস্ত্র।

Advertisement

আরও পড়ুন: মেরুকরণের দায়ে পড়েই যোগীর মুখে কাশ্মীর!

আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। বললাম, এই যে কথায় কথায় বলা, কংগ্রেস জমানাতেও তো এমন হত, এই যুক্তি মোদীকে রক্ষা করার জন্য যাঁরা ব্যবহার করেন তাঁদের বলব, তর্কের খাতিরে না হয় মেনেই নিলাম যত দোষ কংগ্রেসের। ১৯৬৩ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সিবিআইয়ের অপব্যবহার হয়েছে। কিন্তু তা হলে সেটা ২০১৮ সালেও কেন হবে? নরেন্দ্র মোদী তো ২০১৪ সালে এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। ২০১৪ সালের ভোট প্রচারের সময় প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী বিরোধী নেতা মোদীর বক্তব্যের একটা ফুটেজ দেখেছিলাম। তাতে মোদী বলেছিলেন, মনমোহন জমানায় সমস্যা হচ্ছে, গোয়েন্দা আর সিবিআইয়ের মতো তদন্তকারী সংস্থাগুলির মধ্যেই এত কলহ আর মতপার্থক্য— সরকার নিরাপত্তা রক্ষা করবে কী করে? মোদী দুর্নীতি-বিরোধী প্রশাসনের কথা বলেছিলেন, আর সিবিআইতে নম্বর টু গুজরাতের মোদী-ঘনিষ্ঠ অফিসার রাকেশ আস্থানা ক্যাবিনেট সচিব আর সিভিসিকে চিঠি দিয়ে সিবিআই প্রধানের বিরুদ্ধে ১০টি দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের করেছেন। আবার, সিবিআই প্রধান বর্মা, আস্থানার বিরুদ্ধে তিন কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করেন। দুর্নীতির অভিযোগে দু’পক্ষই আদালতের দ্বারস্থ। যাঁরা দুর্নীতির তদন্ত করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাঁদের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ।

আর সিবিআইকে রাজনীতির অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার? আড্ডায় বললাম, বিজেপি নেতা বা কর্মীরা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন কী করে? আবার যাঁরা ক্ষমতাসীন শাসক দলের কৃপাপ্রার্থী ব্যবসায়ী, এমনকি সংবাদমাধ্যমের একাংশ, তাঁরা কোদালকে কী ভাবে কোদাল বলবেন! কিন্তু যখন দেখি পাঁচ বছরে অমিত শাহের পুত্রের ব্যবসা নিয়ে অভিযোগ উঠলেও তদন্ত হয় না, ব্যপম নিয়ে তদন্ত ধামাচাপা পড়ে যায় অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপোকে আক্রমণের লক্ষ্য করা হয়, মায়াবতীর ভাই, অথবা লালুর ছেলেমেয়ের বিরুদ্ধে সিবিআই খড়্গহস্ত! সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে যতই নিরপেক্ষতার দোহাই দিন না কেন, যে কোনও সাধারণ রক্তমাংসের মানুষ যিনি মস্তিষ্ক বন্ধক রাখেননি তিনি কিন্তু মনে করবেন, সিবিআই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে প্রভুর সেবায় নিযুক্ত।

সিবিআই রাজনৈতিক হাতিয়ার অতীতেও হয়েছে এ কথা মানছি। যেমন, যোগিন্দর সিংহ তখন সিবিআই প্রধান। তিনি ছিলেন কর্নাটক ক্যাডারের অফিসার। দেবগৌড়া দেশের কন্নড় প্রধানমন্ত্রী। দেবগৌড়ার পতনের পর গুজরাল। তখন দেবগৌড়ারও সাধ হয়েছিল সিবিআইকে ব্যবহার করে কংগ্রেসকে চাপে রাখার। বফর্স তদন্ত নিয়ে দেবগৌড়ার পরও দর কষাকষি হচ্ছিল। ইন্দ্রকুমার গুজরালের আত্মজীবনীতেই আছে সীতারাম কেশরী তাঁর বাড়িতে প্রাতরাশ করতে এসে বললেন, বফর্স তদন্ত বন্ধ না হলে কংগ্রেস সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবে। আবার দেখুন আডবাণী যখন দেশের উপ-প্রধানমন্ত্রী, বাজপেয়ী তাঁকে পার্সোনেল মন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়ে দিলেও সিবিআইয়ের দায়িত্ব দেননি। আডবাণী তা নিতেও রাজি হননি, কারণ অযোধ্যা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট ছিল, সিবিআইয়ের চার্জশিট থাকায় তিনি সেই দফতরের মন্ত্রী হন কী করে?

আডবাণীকে বলেছিলাম, ছ’বছর ক্ষমতায় থেকেও আপনি পারেননি সিবিআইকে চার্জশিট প্রত্যাহার করাতে। কিন্তু মোদী জমানায় সিবিআইয়ের এত তদন্ত হচ্ছে, কোনও গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিরুদ্ধে কোনও তদন্তই হল না কেন? কোনও চার্জশিট হয়নি। এ-ও এক রহস্য। বরং মানুষ কি এ কথা বিশ্বাস করে না যে গোধরায় সিবিআইয়ের তদন্ত আদালতে শেষ করার জন্য সিবিআই ওই অভিযোগপত্রকে দুর্বল করেছে? আদালতে প্রমাণ হয়নি গোধরা কাণ্ডে মোদী-অমিত শাহরা দোষী। অমিত শাহের পুত্রের সম্পত্তি নিয়ে কংগ্রেস ভ্রুকুটি দেখালেও প্রমাণ কিন্তু হয়নি যে পুত্র দোষী। বরং চিদম্বরম টার্গেট। কিশোরকুমারের গান রাজেশ খন্না গাইছেন। ইয়ে পাবলিক হ্যায়। সব জানতা হ্যায়। আড্ডায় ঠোঁটকাটা ধরদা বললেন, চিদম্বরমই তো মোদীর বিরুদ্ধে সেই মিথ্যে এনকাউন্টারের মামলাটা করেছিলেন। অতএব সিবিআইকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণতার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, এ নিয়ে তো না-বোঝার কোনও অবকাশ নেই। ধরদার বদ্ধমূল ধারণা, সাংবাদিক যাঁরা লিখছেন না, তাঁরা ভয়ে লিখছেন না।

তাই সিবিআইকে নিয়ে অতীতে যদি ভুল হয়, সেই ভুল, সেই অন্যায়কে স্তব্ধ না করে তাকে আরও নগ্ন ভাবে ‘অতিতারা’য় নিয়ে যাওয়া, সে কি অচ্ছে দিনের প্রাপ্তি? আর এখন শুধু কতিপয় আমলাকে দোষী সাব্যস্ত করা কি নরেন্দ্র মোদীর রাজধর্ম? তবে আড্ডায় সব শুনে প্রদীপদা বলছিলেন, যা-ই বলুন আর তা-ই বলুন, জিতবেন কিন্তু মোদীই। দেশের গ্রামের মানুষ সিবিআইতে কী হচ্ছে এ সব বোঝে নাকি? বিধানসভার ভোটে যা-ই হোক, ২০১৯-এ নরেন্দ্র মোদীই আবার। বললাম, অমিত শাহ তো বলেছেন, বিজেপি আগামী ৫০ বছর দেশ শাসন করবে। তা করুক। আমি কোনও দলেরই সক্রিয় কর্মী বা সমর্থক নই। কিন্তু আমি যা বলছি, বিজেপি ভোটে জিতলেও সে দিনও এটাই বলব। কোদালকে কোদাল বলা যাবে না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন