সম্পাদকীয় ১

অকারণ নিষেধ

চলচ্চিত্র মুক্তি পাইবার প্রাক্শর্ত হিসাবে তাহার দৃশ্য বা সংলাপ কাটছাঁট করিবার রীতি বাক্‌স্বাধীনতার বিরোধী, বলিয়াছেন নির্দেশক-অভিনেতা অমল পালেকর। তাঁহার দাবি যথার্থ। গণতান্ত্রিক দেশে কোনও শিল্পকর্ম ‘সেন্সর’ করিবার অধিকার কাহারও নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৪৫
Share:

চলচ্চিত্র মুক্তি পাইবার প্রাক্শর্ত হিসাবে তাহার দৃশ্য বা সংলাপ কাটছাঁট করিবার রীতি বাক্‌স্বাধীনতার বিরোধী, বলিয়াছেন নির্দেশক-অভিনেতা অমল পালেকর। তাঁহার দাবি যথার্থ। গণতান্ত্রিক দেশে কোনও শিল্পকর্ম ‘সেন্সর’ করিবার অধিকার কাহারও নাই। কী কী প্রদর্শনযোগ্য নহে, সে সম্পর্কে আইন থাকিতে পারে। দর্শক চিত্রনির্মাতার বিরুদ্ধে আদালতে যাইতে পারেন। কিন্তু সরকার-নির্দিষ্ট একটি পর্ষদ আগাম বলিয়া দেবে ছবির কোন অংশ বাদ দিতে হইবে, নীতিগত বিবেচনার ধোপে তাহা টিকিবে না। সর্বোপরি, আজ তাহা নিষ্প্রয়োজন। টেলিভিশনে এমন খবরদারির কোনও ব্যবস্থা নাই। ইন্টারনেট তো সেন্সরশিপের ধারণাই প্রায় খারিজ করিয়া দিয়াছে। চলচ্চিত্রের যে সব অংশকে বাদ দিয়াছে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন (সিবিএফসি), সেগুলিও স্বচ্ছন্দে দেখা যায় ইন্টারনেটে। তাহা হইলে শূন্য সিন্দুকে ডবল তালা লাগাইয়া লাভ কী? পালেকর ঠিকই বলিয়াছেন যে, আজকের যুগে চলচ্চিত্র সেন্সর করিবার ধারণাটাই অর্থহীন। তিনি সুপ্রিম কোর্টের নিকট তাঁহার আবেদনে ১৯৫২ সালের সিনেমাটোগ্রাফ আইন এবং চলচ্চিত্রকে শংসাপত্রদান বিষয়ক ১৯৮৩ সালের সরকারি বিধির পরিবর্তন চাহিয়াছেন। সুপ্রিম কোর্ট তাঁহার এই আবেদনের বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এবং সিবিএফসি-র প্রতিক্রিয়া তলব করিয়াছে। যদিও এই বিতর্কও নিষ্প্রয়োজন। কারণ গত বৎসরই শ্যাম বেনেগালের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি চলচ্চিত্র সেন্সর বিষয়ক নিয়মে পরিবর্তনের প্রস্তাব জমা দিয়াছে। সেই সকল প্রস্তাব কার্যে পরিণত করিলেই, ফের হয়তো এই প্রসঙ্গের প্রয়োজন হইত না।

Advertisement

কিংবা হয়তো হইত। ভয় দেখাইয়া কণ্ঠরোধ করিবার যে ঝোঁকটি রাজনীতিতে প্রবল হইয়া উঠিয়াছে, চলচ্চিত্র তাহার বাহিরে নহে। সমাজ দ্রুত বদলায়, আইন বদলাইতে সময় লাগে। তাই অনেক আইন বইয়ে থাকিয়া গেলেও প্রয়োগের অভাবে কার্যত তামাদি হইয়া যায়। সেন্সর বোর্ড কিন্তু ছয় দশকের পুরাতন একটি আইনের প্রবল প্রয়োগ করিয়া চলিয়াছে। একবিংশতেও ভারতে নির্মিত দশ-বারোটি ছবি ছাড়পত্রের অভাবে মুক্তি পায় নাই, আরও অনেকগুলিতে কাটছাঁট করিতে হইয়াছে। অশ্লীলতা তাহার একমাত্র কারণ নহে। কখনও ধর্ম, কখনও রাজ্য, কখনও ঐতিহ্যে আঘাত লাগিবার যুক্তি দেখানো হইয়াছে। যেন ভারতে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক নাই, সকলকেই সরকার-নিয়োজিত কোনও পর্ষদের অভিভাবকত্ব স্বীকার করিতে হইবে। কাশ্মীরের আন্দোলন হইতে পঞ্জাবের মাদক সমস্যা, মুম্বই বিস্ফোরণ হইতে গুজরাতের দাঙ্গা, পর্ষদের মতে কিছুই প্রদর্শনযোগ্য নহে।

ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয়, সেন্সর করিবার পশ্চাতে নাগরিকের নৈতিক উন্নতিবিধানের লক্ষ্য যতটা কাজ করে, তাহার তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় থাকে দমনের ইচ্ছা— তথ্য এবং মুক্তচিন্তাকে দমন। ইজরায়েলে দীর্ঘ দিন জার্মান চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ ছিল। বর্ণবিদ্বেষী দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গের প্রেম দেখাইলে নিষিদ্ধ হইত ছবি। ‘ইসলাম বিরোধিতা’ দেখাইলে ছবি নিষিদ্ধ হয় ইরানে। অর্থাৎ শিল্পের স্বাধীনতা নহে, রাষ্ট্রের প্রতি শিল্পীর আনুগত্যই প্রত্যাশিত। অশ্লীলতা হইতে নীতিহীনতা— শিল্পীদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগের মূলে থাকে কর্তৃত্বের বিরোধিতা, ক্ষমতার অধিপতিদের ধারণা বা মতের বিরোধিতা। আধিপত্যবাদীরা সেই বিরোধিতা সহ্য করিতে নারাজ। এই আধিপত্যবাদীদের মিকেলাঞ্জেলোর বক্তব্যটি স্মরণ করাইয়া দেওয়া প্রয়োজন। সিস্টিন চ্যাপেলে তাঁহার আঁকা ছবি দেখিয়া তৎকালীন পোপ আপত্তি করিয়াছিলেন— দৃশ্যগুলি অশ্লীল, দর্শককে বিভ্রান্ত করিতে পারে। শিল্পী জবাব দিয়াছিলেন, পোপ জগৎটাকে ঠিক করিয়া দিন, আমি এখনই ছবি ঠিক করিয়া দিতেছি।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন