হাইওয়েতে অনেক সময় ‘রাম্বল স্ট্রিপ’-এর ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ, রাস্তায় কিছু সরু অংশকে সামান্য উত্তোলিত রাখা হয় বা তাহার আস্তরণটি অন্য প্রকারের করা হয়, যাহাতে ওই স্থানে টায়ারের শব্দটি বদলাইয়া যাইতেছে বলিয়া, চালকরা বুঝিতে পারেন, হয় তাঁহারা অতিরিক্ত গতিতে যাইতেছেন, অথবা, যখন এই রূপ স্ট্রিপ রাস্তার ধারে অবস্থিত হয়, তাঁহারা কিনারে আসিয়া পড়িয়াছেন। নেদারল্যান্ডসের একটি রাস্তায় অভিনবত্বের জন্য, এই স্ট্রিপ এমন বন্দোবস্ত করিয়া বসানো হইল, যাহাতে তাহার উপর দিয়া গাড়ি যাইলে একটি পরিচিত গান বাজিয়া উঠে। গানটি নিকটস্থ অঞ্চলের ‘জাতীয় সঙ্গীত’ ধরনের, অর্থাৎ ওই অঞ্চলের নিজস্ব ভাষার একটি সমাদৃত ও শ্রদ্ধেয় সম্পদ এবং ঐক্য ও জাতিবোধ-জাগানিয়া। এই বার রাস্তাটির নিকটস্থ অধিবাসীরা খেপিয়া উঠিয়া নালিশ করিয়াছেন। তাঁহারা গানটিকে ভালবাসেন বটে, কিন্তু তাহা চব্বিশ ঘণ্টা কর্ণের সমীপে বাজিয়া তাঁহাদের জীবন অতিষ্ঠ করিয়া তুলিতেছে। তাঁহারা বারান্দায় বাহির হইলে, নিজ বাড়িসংলগ্ন উদ্যানে কিছু ক্ষণ বসিয়া থাকিলে, হাঁটিতে উদ্যত হইলে, সর্ব ক্ষণ শুনিয়া চলিতে বাধ্য হইতেছেন একটিই গান। গান বাজাইবার আগ্রহে গাড়িগুলি নাকি ইচ্ছা করিয়া ওই দাগের উপর দিয়া চলিতেছে। কেহ বলিয়াছেন, ইহা প্রবল মানসিক অত্যাচার। কেহ বলিয়াছেন, ঘুম হইতেছে না, রাত্রিতে ঘন ঘন দ্রুতগতির ট্যাক্সি যাইতেছে ও তাঁহাদের কর্ণের কীট নাড়াইয়া দিতেছে। কেহ বলিয়াছেন, ওই অঞ্চলের নিকট বিমান ঘাঁটি রহিয়াছে, যাহা নিয়মিত ফাইটার প্লেনের উড়ান ও অবতরণের জন্য ব্যবহৃত হয়, সেই শব্দ তাঁহারা মানিয়া লইয়াছেন, কিন্তু সেই শব্দ তবু কিছু ক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়, তদ্ব্যতীত শব্দ সহ্য করা যাইলেও মানুষ অবিরাম সঙ্গীত সহ্য করিতে পারে না।
গান ব্যাপারটি চমৎকার এবং বহু মানুষের নিকট আত্মার আরাম। কিন্তু তাহা বলিয়া কেহ যদি অভিনবত্ব আনয়নের খাতিরে এই সামান্য কথাটি ভুলিয়া যান যে একটি (বা কয়েকটি নির্দিষ্ট) গান অবিশ্রান্ত কাহারও কর্ণের নিকটে চলিলে, এবং তাহাতে শ্রোতার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও ভূমিকা না থাকিলে, তাহা অত্যাচার ভিন্ন কিছুই নহে, তবে তাঁহার বাস্তববোধের অভাব ঘটিয়াছে বলিতে হইবে। বস্তুত কেহ যদি রসগোল্লা ভালবাসেন, তাঁহাকে এক মাস ধরিয়া সকাল-বিকাল কেবল রসগোল্লা খাওয়াইবার ব্যবস্থাই তাঁহার রসগোল্লা-বিবমিষা উদ্রেক করিবার নিশ্চিত উপায়। তাই এমন তর্কও করা যাইতে পারে যে একটি গানকে হত্যা করিবার, তাহার প্রতি শ্রোতার প্রেম ও শ্রদ্ধাকে সমূলে বিনষ্ট করিবার প্রকৃষ্ট উপায় হইল, গানটিকে তাঁহার সম্মুখে চব্বিশ ঘণ্টা বাজাইয়া যাওয়া। এই প্রকারের ব্যবস্থা এমন অঞ্চলে করা ভাল, যেখানে কোনও লোকালয় নাই, হয়তো মরুভূমির মধ্য দিয়া দীর্ঘ রাস্তা চলিয়াছে।
কলিকাতার ট্র্যাফিক সিগনালে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও অন্যান্য গান অনবরত বাজিয়া চলে। সেই সিগনালের সমীপস্থ অঞ্চলে (বা ফুটপাতে) যাঁহারা বাস করেন, তাঁদের হয়তো এত দিনে ‘রবীন্দ্রফোবিয়া’ গজাইয়া গিয়াছে। যানজটে অনন্ত অপেক্ষা করিতে করিতে কত কলকাতাবাসী সঙ্গীতের প্রতি চিরবিদ্বিষ্ট হইয়া উঠিলেন, তাহার খবরই বা কে রাখে। এক প্রখ্যাত লেখক লিখিয়াছিলেন, তিনি এক যানজটে শুনিয়াছিলেন, এক বাইকে এক যুবক সিগনালোত্থিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়া তাহার সঙ্গিনীকে বলিতেছিল, ‘ওই মড়াকান্না শুরু হইল।’ তাহাতে লেখকের প্রচণ্ড ক্রোধ উৎপন্ন হইয়াছিল। তাহা হইতেই পারে, কিন্তু তিনি ভুলিয়া যাইতেছেন, যে কোনও মানুষেরও গান শুনিতে, বা একটি নির্দিষ্ট সময়ে গান শুনিতে, ইচ্ছা না করিতেই পারে। প্রশ্নটি সঙ্গীতানুরাগ লইয়া নহে, প্রশ্নটি বাধ্যতা লইয়া। জোর করিয়া কাহাকেও গান শুনাইবার অধিকার কাহারও নাই। ‘আজি তোমায় ঘাড় ধরিয়া আবার চাই শুনাবারে’ কোনও ভদ্র গণতন্ত্রসম্মত আকাঙ্ক্ষা নহে। কেহ বলিতে পারেন, উড়ালপুল নির্মাণ করিলেও তো কেহ আপত্তি তুলিতে পারেন, তিনি আকাশ দেখিতে পাইতেছেন না। ঠিকই, প্রতিটি নগর-ব্যবস্থাপনা সকলের পছন্দ জিজ্ঞাসা করিয়া করা অসম্ভব, কিন্তু প্রশ্ন হইতেছে অবান্তর ও অপ্রয়োজনীয় বন্দোবস্তগুলি লইয়া। উড়ালপুল ব্যতীত হয়তো যানচলাচল সুষ্ঠু করা যাইবে না, কিন্তু সঙ্গীত না শুনাইলেও সিগনাল দিব্য কাজ করিবে। অবান্তর উপকার করিতে যাইলে সাধারণত মানুষের অপকারের সম্ভাবনা বাড়িয়া যায়।
যৎকিঞ্চিত
এ কথা আমরা সবাই জানি যে দেশে কোনও পৈশাচিক ঘটনা ঘটলে, যেমন ধরা যাক নাবালিকার গণধর্ষণ ও হত্যা হলে, তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার চেয়ে অনেক জরুরি হল ভুজঙ্গাসনের মুদ্রা ঠিকঠাক করা। এও জানি, যে কোনও হৃদয়বিদারক ঘটনায় প্রথম কাজ হল ন্যাকা-ন্যাকা গদ্য বা পদ্য লিখে ফেসবুকে পোস্ট করা। তাতে ঘটনার সুরাহা হবে না বটেই, কিন্তু আমাদের নাম হবে। এবং এই আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়েই, মোরা দেশের রাজার সনে মিলব কাঁঠালের আমসত্ত্বে।