সম্পাদকীয় ১

কেন্দ্র ও কৃষক

ইতিহাস স্মরণীয়। সত্তরের দশকে কৃষিজীবীর রোষ রাষ্ট্রকে ভূমিসংস্কারে বাধ্য করিয়াছিল। অতঃপর কৃষির মুখ হইয়া উঠিয়াছিল প্রধানত উত্তর ভারতের কয়েকটি রাজ্যের বৃহৎ চাষি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৫৫
Share:

কৃষক ক্রুদ্ধ, প্রমাণ করিল গুজরাত। গ্রামীণ এলাকায় একশো সাতাশটি আসনের মধ্যে ভারতীয় জনতা পার্টির জুটিয়াছে মাত্র সাতান্নটি। হারিয়াছেন রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী ধরমশিভাই সাপারিয়া। কৃষিপ্রধান সৌরাষ্ট্র ও কচ্ছে কংগ্রেসের আসন বাড়িয়াছে দ্বিগুণেরও অধিক। তুলার সহায়ক মূল্যের বৃদ্ধি এবং নর্মদা হইতে সেচের জল পৌঁছাইবার প্রতিশ্রুতি না রাখিবার প্রত্যুত্তর পাইল বিজেপি। এই প্রতিক্রিয়াকে অপ্রত্যাশিত বলা চলে না। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কৃষক অসন্তোষ বেশ কিছু কাল ধরিয়াই ধূমায়িত হইতেছে। খাস রাজধানীতেও তাহার প্রকাশ দেখা গিয়াছে। বস্তুত, কংগ্রেস বা অন্য বিরোধী দলগুলি, বিশেষত বামপন্থীরা যে সেই অসন্তোষকে রাজনীতির উপকরণ হিসাবে যথেষ্ট ব্যবহার করিতে পারে নাই, তাহা ওই দলগুলির অপদার্থতার প্রমাণ। গুজরাতে, হয়তো, বিরোধী দলের অপেক্ষা না রাখিয়াই কৃষক তথা গ্রামের ক্ষোভ শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রকাশিত হইয়াছে। আগামী বৎসর বিধানসভা নির্বাচন রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় ও কর্নাটকের মতো রাজ্যগুলিতে— যেখানে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ। অদূরে সাধারণ নির্বাচন। অতএব রাজনীতিতে কৃষক এক নির্ণায়ক শক্তি হইয়া উঠিবে, এমন সম্ভাবনা প্রবল। কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ বাড়িবে আগামী কেন্দ্রীয় বাজেটে, তাহা কার্যত নিশ্চিত।

Advertisement

ইতিহাস স্মরণীয়। সত্তরের দশকে কৃষিজীবীর রোষ রাষ্ট্রকে ভূমিসংস্কারে বাধ্য করিয়াছিল। অতঃপর কৃষির মুখ হইয়া উঠিয়াছিল প্রধানত উত্তর ভারতের কয়েকটি রাজ্যের বৃহৎ চাষি। সবুজ বিপ্লবের কল্যাণে সম্পন্ন ও প্রভাবশালী হইয়া তাহারা চাপ দিয়া সুলভে বিদ্যুৎ, জল, সার আদায় করিয়াছে। সরকারি আনুকূল্যে আয় বাড়াইয়াছে। ঋণ মকুব, সারে ভরতুকি, ফসলের সহায়ক মূল্যে বৃদ্ধি, এমন কিছু দাবিতে সে রাজনীতি আবদ্ধ ছিল। তাহাতে কৃষির মূল সমস্যাগুলির সমাধান হয় নাই। জমি ক্রমাগত ভাগ হইয়াছে, প্রতি জনগণনায় আরও কয়েক লক্ষ মানুষ কৃষক হইতে খেতমজুর শ্রেণিতে আসিয়াছেন। ঠিকা চাষ বাড়িতেছে, অথচ তাহার আইনি মান্যতা নাই, ফলে প্রকৃত কৃষিজীবীর সুরক্ষা নাই। অপর দিকে খরা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রকল্প ফলপ্রসূ হয় নাই। কৃষি সমবায়গুলি সর্বত্র ধুঁকিতেছে, ব্যাংকগুলিও চাষির প্রতি বিরূপ। কৃষি উৎপাদন আজও মহাজন-নির্ভর, বিপণন ব্যবসায়ী-নির্ভর। কৃষি উৎপাদকদের ‘কোম্পানি’ গড়িয়া লাভ হয় নাই। বিভিন্ন রাজ্যে তীব্র কৃষক আন্দোলন সরকারের ধারাবাহিক ব্যর্থতা মনে করাইয়াছে। কৃষক যে বিপন্ন, তাহা অনস্বীকার্য। কিন্তু ঋণ মকুব কিংবা সহায়ক মূল্য দ্বিগুণ করিবার দাবি পূরণ করিলে সমস্যা মিটিবে না। প্রয়োজন কৃষির পরিকাঠামোয় সংস্কার।

অতঃপর নরেন্দ্র মোদীর সম্মুখে দুটি পথ। এক, তিনি জনমোহিনী কিন্তু অপরিণামদর্শী উপায় বাছিতে পারেন। যথা কৃষিঋণ মকুব, এক শত দিনের কাজে বরাদ্দ বৃদ্ধি, ফসলের সহায়ক মূল্যে বৃদ্ধি। তাহাতে নির্বাচনে লাভ হইতেও পারে, কিন্তু অর্থনীতির ক্ষতি মারাত্মক। কৃষিরও লাভ হইবে না। প্রায় নব্বই হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণ ইতিমধ্যেই মকুব হইয়াছে, চাষির আত্মহত্যা কমে নাই। অপর পথ, সংস্কারের লক্ষ্যে অটল থাকা। ফসল বিমা আরও বিস্তৃত ও ফলপ্রসূ করিবার উদ্যোগ, সারের ভরতুকির প্রক্রিয়াতে স্বচ্ছতা, জাতীয় বাজার গড়িয়া কৃষি বিপণনে সংস্কার— মোদী সরকার এই সকল সংস্কারের সূচনা করিয়াছে। এগুলির যৌক্তিকতা যথেষ্ট, সংশয় যথাযথ রূপায়ণ লইয়া। ফসল সংরক্ষণ ও পরিবহণের পরিকাঠামো নির্মাণ, রফতানি বৃদ্ধি, পরিবেশ-বান্ধব কৃষিও প্রয়োজন। ইহার কোনওটিই তৎক্ষণাৎ হইবার নহে। তৎসত্ত্বেও এই সকল দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রতি কৃষকের সমর্থন আদায় করিতে হইবে। সেই কঠিন কর্তব্যের আহ্বান মোদী সরকার গ্রহণ করিবে কি না, এখন তাহাই প্রশ্ন।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন