দিল্লির আচরণে প্রশ্রয় পেয়েছেন জঙ্গি বিমল গুরুঙ্গরা

ঘোলা জলে দিলীপ ঘোষেরা

তবে আপাতত দুটি বিষয় বেশ স্পষ্ট। এক, বিমল গুরুঙ্গ খোলাখুলি সন্ত্রাসের পথ নিয়ে ফেলেছেন। পাহাড়ে প্রাধান্য ‘কায়েম’ রাখা কার্যত অসম্ভব বুঝে তিনি এটাই সহজ রাস্তা বলে চিনে নিয়েছেন।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৭ ০০:১১
Share:

প্রহরী: দার্জিলিংয়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার ডাকা অনির্দিষ্টকালীন বন্‌ধের সময় অমিতাভ মালিক (খাকি পোশাকে)। জুন। ছবি: এএফপি

আমরা সবাই টিভির পরদায় সেই মর্মান্তিক দৃশ্যের সাক্ষী। স্বামীর কফিনবন্দি দেহের উপর লুটিয়ে পড়ে তরুণী বধূর আকুল কান্না সত্যিই অসহনীয়! স্বাভাবিক কারণেই ক্ষোভ-দুঃখ-ক্রোধ-ধিক্কারের প্রতিক্রিয়া সর্বত্র। নিহত পুলিশ অফিসার অমিতাভ মালিকের বাড়িতে আজ দীপাবলির আলো জ্বলবে না। সুস্থ, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষের মনকে সেই আঁধার স্পর্শ করবে।

Advertisement

কিন্তু রাজনীতি বড়ই দয়াহীন। সর্বগ্রাসীও। তাই আনন্দ, বেদনা, সাফল্য, ব্যর্থতা সব কিছুকে নিজের ধর্মে আত্মস্থ করে নিয়ে সে মাথা তোলে। সাড়ে ছাব্বিশ বছরের তরতাজা অমিতাভের মৃত্যু এ ক্ষেত্রে কোনও ব্যতিক্রম নয়। হবেই বা কেন!

কীভাবে, কোন পরিস্থিতিতে তাঁর মৃত্যু হল তা নিয়ে ইতিমধ্যেই নানা মহলে নানা আলোচনা এবং সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। গুরুঙ্গ-পাকড়াও অভিযানে আগুয়ান ভূমিকায় থাকা অমিতাভ মালিক ঠিক কোন অবস্থানে ছিলেন, তাঁর পিছনে ‘কভার’ কেমন ছিল, কী করে তাঁর কপালের ঠিক ওপরে ডান দিক থেকে গুলি ছুটি এল, এমন আক্রমণের মোকাবিলায় আগাম কতটা প্রস্তুত ছিল পুলিশ বাহিনী, ইত্যাদি নানান প্রশ্ন গত কয়েক দিন ধরে ঝাঁক ঝাঁক গুলির মতোই ধেয়ে আসছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিতেও যথারীতি নানা মুনি নানা মত দিচ্ছেন। আশা করা যায়, সরকারি তদন্ত রিপোর্টে এমন বহু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে।

Advertisement

তবে আপাতত দুটি বিষয় বেশ স্পষ্ট। এক, বিমল গুরুঙ্গ খোলাখুলি সন্ত্রাসের পথ নিয়ে ফেলেছেন। পাহাড়ে প্রাধান্য ‘কায়েম’ রাখা কার্যত অসম্ভব বুঝে তিনি এটাই সহজ রাস্তা বলে চিনে নিয়েছেন। এবং দুই, দিল্লির শাসক শিবিরের বিভিন্ন কথা ও কাজ থেকে গুরুঙ্গরা প্রশ্রয়ও পাচ্ছেন।

রাজনীতিতে ‘সময়’ ব্যাপারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কখন কী বলতে হয়, কী করতে হয়, সেই পরিমিতিবোধ ও বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করা রাজনীতিকদের পক্ষে জরুরি। নইলে কোনও ‘মহৎ’ উদ্দেশ্যও অনায়াসে ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে অভিসন্ধি নিয়ে। যেমন উঠছে দার্জিলিং নিয়ে বিজেপির ভূমিকায়।

বিমল গুরুঙ্গের নেতৃত্বে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে অগ্নিগর্ভ আন্দোলন শুরু হয়েছিল ৮ জুন। সে দিন দার্জিলিঙের রাজভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠক করতে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর মন্ত্রীরা। রাজভবন ঘিরে ফেলে গুরুঙ্গ-বাহিনী যে তাণ্ডব শুরু করেছিল, তা এত দিনে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে সেটা এখন আর সবিস্তার বলার অপেক্ষা রাখে না।

অচলাবস্থা কাগজে-কলমে কেটেছে। আগের মতো সব কিছু ঝাঁপ বন্ধ হয়ে রয়েছে, তা-ও নয়। তবু দার্জিলিং তার পুরনো চিরাচরিত চেহারায় ফিরে এসেছে বললে হয়তো পুরোপুরি ঠিক বলা হবে না। একটা চাপা অনিশ্চয়তা এখনও পাহাড়ের প্রতিটি বাঁকে ওত পেতে ভয় দেখাচ্ছে।

মাঝখানের এই পর্বে গুরুঙ্গ জিটিএ চেয়ারম্যানের পদ খুইয়েছেন। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ভেঙেছে। উঠে এসেছেন বিনয় তামাঙ্গ, অনিত থাপারা। বিমলের বিরুদ্ধে পাহাড়ের অন্য দলগুলিকে একজোট করার প্রকল্পও অনেকাংশে সফল। আর গুরুঙ্গ মাথায় ফৌজদারি অভিযোগ নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ইউএপিএ জারি হয়েছে। এই অবস্থায় বন্দুকের নলই তাঁর দাপট দেখানোর প্রকৃষ্ট পথ! প্রথম দিকে আড়াল থেকে হুমকি চলত। এ বার হল সরাসরি গুলির লড়াই। প্রাণ গেল তরুণ পুলিশ অফিসারের।

আর বিজেপি কী করল? তাদের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ফেসবুকে লিখলেন, ‘‘বিমল গুরুঙ্গের ওপর রাজ্য সরকারের অকারণ আক্রমণ আমরা সমর্থন করি না।’’ দলের রাজ্য সভাপতি যখন ‘আমরা’ বলেন, তখন ধরে নিতেই হবে, তাঁর কথা আসলে তাঁর দলের কথা।

তাঁর চার অনুচ্ছেদের ওই ফেসবুক পোস্টে নিহত পুলিশ অফিসার সম্পর্কে একটি শব্দও খরচ করা হয়নি! এমনকী, গোপন ডেরা থেকে গুরুঙ্গের দলবল যে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিবৃষ্টি করেছে, উল্লেখ নেই তারও। ভাবখানা যেন, নিতান্ত অহিংস, শান্তিপ্রিয়, গণতন্ত্রপ্রেমী, গাঁধীবাদী বিমল গুরুঙ্গ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার! অতএব ‘বেচারা’ গুরুঙ্গকে রক্ষা করা সকলের পবিত্র কর্তব্য!

এখানেই শেষ নয়। এক সমাবেশে দাঁড়িয়ে বিজেপির নেতাটি এই প্রশ্নও তুলেছেন, আত্মরক্ষার উপযুক্ত পোশাক ছাড়া ওই পুলিশ অফিসার অভিযানে গিয়েছিলেন কেন? অফিসারের পরিবার ও পুলিশ কর্তারা সকলেই অবশ্য দিলীপবাবুর ওই বক্তব্যকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে বিজেপি নেতার কথা থেকে এটুকু পরিষ্কার, গুরুঙ্গ-বাহিনী আক্রমণ চালিয়েছিল। সে ক্ষেত্রে গুরুঙ্গের ওপর ‘অকারণ আক্রমণের’ যুক্তি ধোপে টেকে কি?

বিজেপির এই ‘অগ্নিপুরুষ’ দিন কয়েক আগেই দার্জিলিং এবং সিকিম সফরে গিয়েছিলেন। দার্জিলিঙে তাঁরা নিগৃহীত হন। যা কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু ‘সময়’ বেছে ঠিক এখনই তিনি ওখানে গেলেন কেন, সেই প্রশ্ন এড়ানো যায় না। আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ওই সফরে গুরুঙ্গের সঙ্গে তাঁর ফোনে কথা হয়েছে বলে দিলীপবাবু নিজেই দাবি করেছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গে থেকে পালিয়ে গুরুঙ্গ পাশের রাজ্য সিকিমে ‘নিরাপদ’ আশ্রয় পাচ্ছেন, এটা এখন আর গোপন নেই। প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্র থেকে তাঁকে মদত করা হচ্ছে বলেও খবর। বিজেপি বা কেন্দ্র কিন্তু এ সব নিয়ে এখন পর্যন্ত টুঁ শব্দ করেনি। অথচ শাসক দলেরই এক দায়িত্বশীল নেতা তাঁর সঙ্গে কথা বলে আসছেন! গুরুঙ্গের শিবির থেকে পুলিশের উপর সশস্ত্র আক্রমণ চালানোর পরেও প্রকাশ্যে গুরুঙ্গের পক্ষে সওয়াল করছেন! এ কেমন রাজনীতি?

প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পরে জানা গেল, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নাকি দলের রাজ্য সভাপতির এহেন কার্যকলাপ ও কথাবার্তা অনুমোদন করেন না। তাঁকে নাকি ‘সতর্ক’ করা হয়েছে। কোথায়, কবে, পার্টি অফিসের কোন গহন কোণে সেই বার্তা পৌঁছেছে, জানা কঠিন। তবে দল যদি সত্যিই মনে করে কারও নির্বুদ্ধিতার কারণে মুখ পুড়ছে, প্রকাশ্যে তা বলা হল না কেন? বিশ্বাসের ফাঁক ভরাট হওয়া মুশকিল।

সবাই জানেন, ১৯৮৬-৮৭’তে সুবাস ঘিসিঙ্গর জিএনএলএফ যখন গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে দার্জিলিং অগ্নিগর্ভ করে তুলেছিল, তখনও বহু সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনী, আন্দোলনকারী, সব পক্ষেই জীবনহানি হয়েছে। অশান্তি সৃষ্টির কারণে আঙুল উঠেছে ঘিসিঙ্গর দিকে। নেপালের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগের কথাও সামনে এসেছে তখন। দার্জিলিং পরিস্থিতি ঘিরে কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদও হয়েছে বার বার। তখনও ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের প্রশ্নে তীব্র টানাপড়েন চলেছে। কিন্তু ঘিসিঙ্গ নিজেকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করেননি। তাঁকে পালিয়ে গোপন ডেরা থেকে আক্রমণ শানাতে হয়নি। বরং রাজনৈতিক মোকাবিলার জন্য তাঁর দরজা সব সময় খোলা থাকত। আপাত ভাবে একটা সমাধানও কিছু দিনের জন্য হয়েছিল।

এ বার কিন্তু গুরুঙ্গের সব রকম জঙ্গিপনা সত্ত্বেও দিল্লি সময় মতো তাঁদের শাসন করার পথে যায়নি। কিছুটা প্রশ্রয় জুগিয়েছে। যদিও তাঁদের সংযত করার যথেষ্ট ‘অস্ত্র’ কেন্দ্রের হাতে ছিল। আজ পরিস্থিতি অনেকটাই ঘোরালো। এবং এখনও দিলীপ ঘোষ মার্কা বিজেপি নেতারা সেই ঘোলা জলে দাঁড় বাইছেন! কোথাও এক বারের জন্য তাঁদের রাশ টানা হচ্ছে বলে মনে হয়নি।

‘সময়ের’ রাজনীতি বুঝি একেই বলে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন