Christmas

বড় কাহাকে বলে

স্নায়ুরোগে রুগ্ণ এক মধ্য-আশির জেসুইট ফাদার ভারতের বঞ্চিত আদিবাসী ও দুর্গত সমাজের সেবাসাধনায় তাঁহার সারা জীবন কাটাইবার পর এই বড়দিন উৎসবে বসিয়া আছেন ভারতের একটি জেলের আঁধার কোণে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ ০২:১৪
Share:

প্রতীকী ছবি।

দিনকাল পাল্টাইয়াছে। বড়দিনও পাল্টাইয়াছে। কান পাতিলে এখন শোনা যায়, বড়দিনটি ভারী বড়, কেননা এই দিনে নাকি সান্টা ক্লজ় আসেন উপহার বিলাইতে। বহু দিন হইল, পঁচিশে ডিসেম্বর জিশু দিবস হইতে সান্টা দিবসে পরিণত হইয়াছে। বাজারতন্ত্র ও তাহার আবশ্যক সহচর, বিজ্ঞাপনতন্ত্র বড়দিনের সমূহ সর্বনাশ ঘটাইয়াছে। বিশ্বসংসার এখন এই দিনটিকে নিছক ফুর্তি, কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়ার দিন বলিয়াই জানে। যাহা ছিল ‘দিবার’ উৎসব, তাহা পাল্টাইয়া হইয়াছে ‘পাইবার’ উৎসব। বিশ্বসাথে নিজযোগে যে দিনটি কাটাইবার কথা ছিল, তাহা বাঁধা পড়িয়াছে কেবল নিজ নিজ ক্ষুদ্র আকাঙ্ক্ষা পূরণের ডোরে। ছেলেমেয়েরা শিখিয়াছে, সান্টা আসেন তাহাদের জন্য, তাহাদের আশ মিটাইয়া জিনিস দিতে। বাবা-মায়েরা বুঝিয়াছেন, বড়দিনের সামান্য বন্দোবস্ত মানে মল মার্কেট শপিং লিস্ট, আর অসামান্য উদ্‌যাপন মানে চর্ব্য-চোষ্য ও পেয় সহযোগে সকালে পিকনিক রাতে পার্টি। কোভিড-কালেও শহরে নগরে জনারণ্যে নামিয়া আসিয়াছেন সান্টারা, তাঁহাদের ঝুলি হইতে যাহা বিতরিত হইতেছে, তাহার সামান্য কিছুও অভাবীর অভাব দূরের লক্ষ্যে ধাবিত হইবার জো নাই। দুই হাজার কুড়ি বৎসরকাল আগে, জেরুসালেম-এর উপান্তে সামান্য কুটিরে তিন মেষপালকের আশ্রয়ে মেরির কোলে যে জিশু জন্ম লইয়াছিলেন, মানবদুঃখ দূর করিতে গিয়া যে জিশু আত্মত্যাগের চূড়ান্ত নজির স্থাপন করিয়াছিলেন— আজ তাঁহার নামে চলিতেছে বর্ণাঢ্য ধনাঢ্য স্বার্থসন্ধানের প্লাবন। ধর্মযোগ দূরস্থান, কর্মযোগও আজ প্রবল পরাভূত, পড়িয়া রহিয়াছে কেবল— ফুর্তি। সভ্যতার খাতিরে ফুর্তির নামে গাল পাড়িতে নাই, কিন্তু এক বার অবকাশমতো দুই দণ্ড ভাবিয়া দেখা যায়, ফুর্তি বস্তুটি মানবতার অগ্রগমন ঘটাইতেছে, না পশ্চাদপসরণ।

Advertisement

‘পর’ হইতে ‘আত্ম’র দিকে বড়দিনের অভিমুখ ঘুরিবার ও সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টীয় সংস্কৃতির বৃহৎ আদর্শ লোপ পাইবার বাস্তব কোনও একটি দেশের দুর্ভাগ্য নহে, গোটা দুনিয়ার দস্তুর। কিন্তু তাহার মধ্যেও যদি আলাদা করিয়া তাকানো যায় ভারতের দিকে? দেখা যাইবে, কোভিড-সঙ্কট তুচ্ছ করিয়া অন্যান্য বারের মতো এ বারেও বড়দিনের উৎসাহ, উদ্দীপনা, এমনকি উৎসব। মহানগরগুলিতে রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ঢল। যদি-বা কোথাও চকিতে চোখে পড়িতেছে মাস্ক-পরিধানের সচেতনতা, দূরত্ববিধি মানিয়া চলিবার দৃষ্টান্ত দুর্লভ। সন্দেহ নাই, মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের মধ্যে একটি সৌন্দর্য আছে, বিশেষত প্রায় গোটা একটি বৎসরের আশঙ্কিত, সঙ্কটগ্রস্ত সময়যাপনের শেষে মানুষকে খুশি দেখিলে পার্থিব জীবনের প্রতি আবার বিশ্বাস ফিরিয়া আসিবারই কথা। কিন্তু, অনন্যোপায় চেতনা কি ভুলিতে পারে যে, এই সকল আনন্দই কেবল আড়ম্বরের অভিমুখে, আত্মসুখের লক্ষ্যে— নিজের পরিবার-পরিজনের বাহিরে যে ‘পর’, তাহার জন্য

এই আনন্দক্রোড়ে তিলমাত্র স্থান নাই। হাতে-গোনা ব্যতিক্রম ছাড়া, কিছু নাছোড় সমাজসেবী ও সমাজসচেতন সংগঠন ছাড়া ভারতীয় বড়দিনের মধ্যে কোনও আত্ম-অতিক্রমী অনুভূতি যেন সোনার পাথরবাটি।

Advertisement

অতিমারি-কবলিত দুনিয়ায় এই বাস্তব চিত্র আরও বিশেষ ভাবে পীড়াদায়ক। ২০২০ সাল দেখিয়াছে দেশজোড়া পরিযায়ী শ্রমিকের অবর্ণনীয় দুর্দশা, দেখিয়াছে কী ভাবে পশ্চিমবঙ্গের বিরাট গ্রামসমাজ বিধ্বস্ত হইয়াছে আমপানে, কী ভাবে কোভিড কাড়িয়া লইয়াছে সহস্র লক্ষ মানুষের জীবিকা। বর্তমান ভারত-শাসকদের সৌজন্যে দিকে দিকে কৃষকেরা ক্ষুব্ধ, আন্দোলন-অবরোধে শামিল। প্রতিবাদী মানুষেরা নির্যাতিত, এমনকি কারারুদ্ধ। শুধুমাত্র শাসকের সমালোচনা করিয়া যাঁহারা জেলে স্থান পাইয়াছেন, তাঁহাদের মানবাধিকার বলিতে কিছু অবশিষ্ট নাই, এমনকি প্রবীণ সমাজেসবীদেরও নহে। জিশু দিবসের ঘনঘটার মধ্যে নাগরিকের কি মনে পড়িতেছে, স্নায়ুরোগে রুগ্ণ এক মধ্য-আশির জেসুইট ফাদার ভারতের বঞ্চিত আদিবাসী ও দুর্গত সমাজের সেবাসাধনায় তাঁহার সারা জীবন কাটাইবার পর এই বড়দিন উৎসবে বসিয়া আছেন ভারতের একটি জেলের আঁধার কোণে? কতিপয় সাংবাদিক ও সমাজসেবী ব্যতীত গোটা সমাজে কি ইঁহাদের লইয়া সামান্য দুর্ভাবনাও অবশিষ্ট আছে? বাস্তবিক, স্ট্যান স্বামী নিজেই একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত, কেন তাঁহার আপন সংস্কৃতির বড়দিনটি বিশ্বে এবং ভারতে আর তত ‘বড়’ নাই। চার দিকে মানব-অধিকারের চরম অবমাননার চৌহদ্দিতে ইহা আর একটি ফুর্তি-দিবস মাত্র।

যৎকিঞ্চিৎ

রাজনৈতিক তরজা বোঁ করে মেগাসিরিয়াল হয়ে যাওয়ায়, এবং পার্সোনাল ও পলিটিক্যাল সম্পূর্ণ হাতিমি হয়ে যাওয়ায়, রসিকতার বান ডেকেছে। হাসতে পারা ভাল, বিশেষ করে এই সময়ে। তবে, এটাও খেয়াল করা ভাল যে, স্ত্রী দল পাল্টালে স্বামী টিভি ক্যামেরার সামনে বসেই তাঁকে মুহূর্তে তালাক দিচ্ছেন, থুড়ি, ত্যাগ করছেন। ঘরের বৌ নিজের মর্জিতে চললে পুরুষসিংহরা যেমনটা করে থাকেন। তা-ও বাংলা বলে বাঁচোয়া, উত্তরপ্রদেশ হলে হয়তো ‘অনার কিলিং’-ই ঘটে যেত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন