কিন্তু স্কুলের গণ্ডির বাইরে?

গ্রামের দিকে চাকরি করতাম এক সময়। পাশের এক স্কুলে মাঝে মাঝে রান্না করা খাবার না দিয়ে চালডাল ইত্যাদি দেওয়া হত। মেয়ে থলিটা কোনও মতে বয়ে আনত স্কুলের বাইরে।

Advertisement

সোনালী দত্ত

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৪২
Share:

মেয়েটা সেই পুরনো শার্টটাই মিডির সঙ্গে পরে আসে, রোজ। অথচ নতুন জামা দেওয়া হয়েছে কিছু দিন আগেই। দিদিমণি জিজ্ঞেস করেন, “নতুন শার্ট কই?” উত্তর আসে, “ওই জামাটা দাদা নিয়ে নিয়েছে। দাদার একটা জামায় চলে না।” পুত্রসন্তান যখন, তার দাবি নিয়ে তো আর বাড়িতে প্রশ্ন উঠবে না, তাই রোগাসোগা মেয়ে-সন্তান ছেঁড়া নোংরা জামা পরে স্কুলে আসবে।

Advertisement

গ্রামের দিকে চাকরি করতাম এক সময়। পাশের এক স্কুলে মাঝে মাঝে রান্না করা খাবার না দিয়ে চালডাল ইত্যাদি দেওয়া হত। মেয়ে থলিটা কোনও মতে বয়ে আনত স্কুলের বাইরে। তার পর অভিভাবক সেটা নিয়ে নিতেন। মেয়ের ভার লাঘব হত। থলির ভেতরের জিনিস আর তার কাজে লাগত না। সে অর্ধভুক্তই থেকে যেত। মেয়েদের আবার খিদে কী?

ভাল লাগে যখন ওরা ব্যাগ পায়, বই পায়, সাইকেল পায়। ভাল লাগে যখন ওরা কন্যাশ্রী হয়। ভাল লাগে না যখন পরীক্ষার পর এসে শুকনো মুখে মেয়ে দিদিমণির সামনে দাঁড়ায়। বাড়িতে রান্না হয়নি। মা, বাবা অসুস্থ। মেয়ে গিয়ে চালের জোগাড় করবে, তবে রান্না।

Advertisement

না, সব স্কুল এখনও নির্বিকার হয়ে যায়নি। চেষ্টা করা হয়, যদি এই সব নির্যাতিত, অভুক্ত মেয়েগুলোকে একটু খাবার, একটু আশ্রয় দেওয়া যায়। বাইরের মানুষ পরিসংখ্যান দেখেন। দিদিমণিরা দেখেন, ডিসেম্বরের শীতে ক্লাসরুমে বসে ছাত্রী কেমন কাঁপছে। ইউনিফর্মের সোয়েটার তো নেইই, কোনও গরম জামাই নেই। স্কুল চেষ্টা করে সামর্থ্য অনুযায়ী; কিন্তু আশ্বাসের উষ্ণতা সব পীড়িতকে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা তো স্কুলের নেই!

এ ছাড়াও আরও অন্য সমস্যা রয়েছে। অনেকেই নাবালিকার বিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। স্কুল খবর পেলে সচেষ্ট হয় ঠেকাতে। প্রশাসনের সহায়তায় হয়তো মেয়েটি সে যাত্রা রক্ষাও পায়। তবু সে যখন স্কুলের পরিমণ্ডলের বাইরে চলে যাচ্ছে তখন তার নিরাপত্তার ব্যাপারটা আর নিশ্চয়তা পাচ্ছে না। ঘরে ঘুমিয়ে থাকা সাত বছরের শিশুকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে। আড়াই বছরের দুধের শিশুও পার পাচ্ছে না। ফুটপাতের মেয়েই হোক বা
ঝাঁ-চকচকে স্কুলের শিশু— যৌনতা বোঝার আগেই শিশুর যৌনাঙ্গ রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, এ দেশে প্রাত্যহিক ধর্ষণের এক চতুর্থাংশ হয় নাবালিকার ওপর।

আমরা পুলিশ, প্রশাসনের কাছে আরও অনেক বেশি সতর্কতা দাবি করতে পারি। কিন্তু মানুষের মনে যে ভয়ংকর বিকৃতি দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়ছে, তাকে রোধ করার উপায় কী, কেউ ঠিকঠাক বলতে পারছেন না। আসলে আমাদের সামাজিক শিক্ষার মূলে যে নারীবিদ্বেষ, তা-ই বোধহয় আধুনিক ভোগবাদের আশকারা পেয়ে এই লোলুপ হিংস্র বাস্তবকে তৈরি করছে। কিছু হিংস্রতা আছে যাকে আমরা সহজেই চিনে নিতে পারি, যেমন আজকাল ধর্ষককে সামনে পেলে জনগণই হাতের সুখ মিটিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু কিছু হিংস্রতা আছে যাকে আমরা নিত্যদিনের অংশীদার করে নিয়েছি। যেমন বাড়িতে যখন মাছের বড় টুকরো ছেলের পাতে পড়ে আর মেয়ের ভাগে থাকে নিমিত্তমাত্র, যখন বাড়ি থেকে কিচ্ছু না খেয়ে স্কুলে এসে মেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়, যখন নিজের বাবা-কাকা আদরের নামে অবোধ মেয়েকে উত্ত্যক্ত করে, যখন বিবাহবিচ্ছিন্ন অভিভাবকের মেয়ের কোনও আশ্রয় থাকে না, তখন সরকার, স্কুল শত চেষ্টাতেও খুব কিছু করতে পারে না। এই হিংসাকে আমরা বুঝতে পারি না, আর তাই চিনতে পারি না। আবার, বাড়ি যখন বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে যায়, তখন বহু কিশোরী মেয়ে বয়সের ধর্ম মেনে কোনও পুরুষের হাত ধরে নতুন দুনিয়ায় নতুন বাড়ি তৈরি করার স্বপ্ন নিয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। তার পর কারও কারও স্থান হয় দেহোপজীবিনীর আবাসে।

অনেক সময় এ সব এড়ানোর কোনও উপায় থাকে না। এই সমস্যা মোকাবিলার উপায় হল সচেতনতা। মা-বাবার যেমন দায়িত্ব, স্কুলেরও এ ব্যাপারে দায়িত্ব নেওয়া উচিত। এবং এই সচেতনতা কেবল মেয়েদের নয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ছেলেদেরও সমান প্রয়োজন। এখন অভিভাবকরা কন্যাদের ধর্ষিতা হওয়ার থেকে বাঁচাবার জন্যে যেমন ‘গুড টাচ, ব্যাড টাচ’ ইত্যাদি শেখাচ্ছেন, পুত্রকেও ধর্ষক হওয়ার ভবিষ্যৎ থেকে রক্ষা করার জন্যে তার মনে তথাকথিত পৌরুষের ধারণা গেঁথে দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন।

এ কাজ শুধু পরিবার দিয়ে হবে না। স্কুলের সিলেবাসের মধ্যে এই সব বিষয় আনতে হবে। মা- বাবাকে ডেকে আলোচনায় বসতে হবে। আবাসিক স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে হবে। অথবা সংখ্যায় কম হলেও প্রত্যেক স্কুলে নির্যাতিত, অবহেলিত ছাত্রীদের কিছু থাকার জায়গা তৈরি করতে হবে। যেখানে তারা আশ্রয় আর নিরাপত্তা পাবে।

কন্যাশ্রীরা যতক্ষণ স্কুলে থাকে ততক্ষণ তাদের নিরাপত্তা, তাদের স্বার্থ নিয়ে ভাবার অনুকূল একটা পরিমণ্ডল আজকাল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গড়ে ওঠে, এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু স্কুলের বাইরের দুনিয়া বড় কঠিন। সেখানে আমাদের মেয়েরা কী ভাবে সুস্থ এবং সুরক্ষিত থাকবে, সরকার সে কথাও ভাবুক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন