হীরকরাজ পাঠশালা বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্যাথলজিকাল ল্যাবরেটরিগুলি বন্ধ করেন নাই, শুধু বলিয়াছেন, উহারা ভুল রিপোর্ট দিতেছে। যাহাকে ডেঙ্গি বলিতেছে, তাহা নিতান্তই ‘অজানা জ্বর’। যে রাজ্য প্রতি বৎসর ডেঙ্গিতে, থুড়ি, অচেনা জ্বরে, পুড়িয়া যায়, সেখানে দীর্ঘ দিন যাবৎ কোনও পূর্ণ সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাই। তবে, স্বাস্থ্যনীতি বিলক্ষণ আছে— ‘অস্বীকার করা’। ডেঙ্গির অস্তিত্ব, এবং তাহার ব্যাপ্তির ভয়াবহতা যদি সপাট অস্বীকার করা যায়, তাহা হইলে সরকারের আর কোনও দায় থাকে না। জনস্বাস্থ্য নামক বিষয়টি যে নিতান্তই ছেলেখেলার, বছর বছর জ্বর হইলেও মশা নিয়ন্ত্রণের কোনও চেষ্টা না করা যে নিতান্তই স্বাভাবিক, সরকার তাহা বুঝাইয়া দিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের পর স্বভাবতই প্যাথ ল্যাবগুলির হাত কাঁপিতেছে, চিকিৎসকরাও আতঙ্কিত। গোলাপকে যে নামে খুশি ডাকিলে দোষ নাই, কিন্তু জ্বরকে ‘ডেঙ্গি’ বলিয়া ফেলিলে ঘাড়ে মাথা থাকিবে কি না, সে বিষয়ে কেহ নিশ্চিত নহেন। ফলে, বহু ক্ষেত্রে জ্বরের কারণটি অজ্ঞাতই থাকিতেছে। মৃত্যু-মিছিল অব্যাহত। মহানগরীতেও। পুরসভার কর্তারা আশ্বাস দিয়াছেন, পরিস্থিতি উদ্বেগজনক নহে। কত হাজার মরিলে তবে তাঁহাদের উদ্বেগ জাত হইবে, মুখ্যমন্ত্রী জানেন নিশ্চয়।
কেন সরকার ডেঙ্গির পরিসংখ্যান চাপিয়া রাখিতে চাহে, তাহা অনুমান করিবার জন্য কোনও পুরস্কার নাই— প্রকৃত চিত্রটি স্বীকার করিলে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা সম্পূর্ণ প্রকাশ্যে চলিয়া আসিবে। কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রীর নিকট একটি প্রশ্ন নিবেদন করা প্রয়োজন। ‘অচেনা জ্বর’কে ডেঙ্গি হিসাবে চিহ্নিত করিবার পিছনে বেসরকারি ল্যাবরেটরি বা ডাক্তারদের স্বার্থ কী? আশা করা চলে, মুখ্যমন্ত্রীর নিকট কোনও যুক্তিগ্রাহ্য জবাব থাকিবে, তিনি সিপিআইএম বা মাওবাদীদের চক্রান্তের তত্ত্ব খাড়া করিবেন না। আরও আশা, তিনি নিজের মন্তব্যের তাৎপর্যও বুঝিতে সক্ষম। তাঁহার মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় চিকিৎসকরা যদি ডেঙ্গিকে ‘ডেঙ্গি’ বলিতে ভয় পান, জনস্বাস্থ্যে তাহার কতখানি মারাত্মক প্রভাব পড়িবে, তাহা সম্পূর্ণ বিচার করিয়াই মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্যটি করিয়াছেন। এই যুক্তি মানিলে বুঝিতে হয় যে, বিনা চিকিৎসায় বা ভুল চিকিৎসায় মানুষের মৃত্যুর গুরুত্ব অপেক্ষা তাঁহার নিকট সরকারের গাফিলতি ঢাকিবার তাগিদ বেশি। তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দেওয়া প্রয়োজন, দোষ ঢাকিবার চেষ্টা ব্যতিক্রমহীন ভাবে বিপরীতফলদায়ী হয়। পার্ক স্ট্রিটের ‘সাজানো ঘটনা’র কাহিনি না-হয় উহ্য থাকুক, শাসক দলের ‘ছোট ছেলেদের ছোট ভুল’ ঢাকিবার চেষ্টায় পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলার মর্মান্তিক ক্ষতি হইয়াছে। স্বাস্থ্য পরিষেবায় সেই কুনাট্যের পুনরভিনয় আরও বিপজ্জনক, আরও মারাত্মক।
গাফিলতি যে শুধু ডেঙ্গি রোধ করিবার ক্ষেত্রে, তাহা নহে। পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের উপর সরকারের আস্থা বিপুল। তাহারা একটি জোড়াতালি দেওয়া ব্যবস্থায় প্লেটলেট গনিয়াই ডেঙ্গি আছে কি না, সেই ফয়সলা করিতেছে। কারণ, ডেঙ্গি নির্ণয়ের যে প্রামাণ্য পরীক্ষা, তাহার ব্যবস্থা পুরসভার ১৫টি ল্যাবরেটরির একটিতেও নাই। কেন নাই, সেই প্রশ্নের একাধিক অপযুক্তি মজুত আছে। কিন্তু, কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠান যে পরীক্ষা না করিয়াই ‘ডেঙ্গি নাই’ বলিয়া রোগীকে ছাড়িয়া দিতে পারে, তাহা সত্যই অকল্পনীয়। এই ভ্রান্ত নির্ণয় কতখানি মারাত্মক হইতে পারে, মুখ্যমন্ত্রী বা মেয়র সম্ভবত ভাবিয়া দেখেন নাই। হাজার হউক, রাজ্যের মোট ভোটারের অনুপাতে ডেঙ্গিতে আর কত জনই বা মারা যাইতেছেন? যাহাতে ভোট কমে না, নেতারা তাহা লইয়া ভাবেনও না। তাঁহাদের নিকট রাজনীতিই আসল, প্রশাসনিকতা নিতান্তই বাহুল্য।