যে পোশাকে স্বচ্ছন্দ, তাই-ই ‘ড্রেসকোড’

বিষয়টা অনেক সহজ ও সাবলীল হয়ে এসেছে। নিজেদের ‘আইডেন্টিটি’ নিয়েও তাদের যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছে। স্কুলের সহকর্মীদের মধ্যে ক্রমশ এই পোশাক নিয়ে ‘রিজার্ভেশন’ কমেছে। এলাকার মানুষও পেশার সঙ্গে পোশাকের সম্পর্কহীনতা দিনে দিনে উপলব্ধি করছেন। লিখছেন বিদিশা ঘোষ।পরের বছর নতুন শিক্ষাবর্ষে ছেলে-মেয়েরা ভর্তি হওয়ার সময় স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে, আমার সহকর্মীদের কাছে, যে ছাত্রীরা ক্লাস এইট-নাইনে উঠল, তাদের অভিভাবকদের কাছে এবং সমাজের কাছে আমার ভাবনা ও মতটি প্রকাশ করলাম।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৯ ০১:০৫
Share:

ক্লাসে লেগিংস পরে ছাত্রীরা। আগে এ কথা ভাবা যেত না। ছবি: লেখক

আজ থেকে চোদ্দো বছর আগে গ্রামের স্কুলে জয়েন করার পরে ‘ড্রেসকোড’ বিষয়টি আমার নজরে বা ভাবনায় আসে। পোশাক হবে আরামদায়ক, স্বচ্ছন্দ, সুবিধাজনক ও রুচিসম্মত। সে যেই হোক না কেন, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী সকলের জন্যই। এটা ‘আইডেন্টিটি’-র প্রশ্নও বটে।
স্কুলে এসে প্রথম বছরটা টানা শাড়ি পরেই স্কুলে গেছি আর অপেক্ষা করেছি। ছাত্রীদের অসুবিধে আমার চোখে পড়ছিল। সে তুলনায় ছাত্রেরা ছিল স্বচ্ছন্দ। নিজের স্বাচ্ছন্দ্য এবং ব্যক্তিগত বিষয়ে অধিকারের প্রশ্নটি মুলতুবি রেখেছিলাম, ওদের সমস্যাটা আগে চিহ্নিত করব, এই প্রতিজ্ঞায়। পরের বছর নতুন শিক্ষাবর্ষে ছেলে-মেয়েরা ভর্তি হওয়ার সময় স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে, আমার সহকর্মীদের কাছে, যে ছাত্রীরা ক্লাস এইট-নাইনে উঠল, তাদের অভিভাবকদের কাছে এবং সমাজের কাছে আমার ভাবনা ও মতটি প্রকাশ করলাম।

Advertisement

বর্ষাকালে বৃষ্টি পড়লে বীরভূমের বড়া গ্রাম এখনও ভরে যায় এঁটেল কালো কাদায়। তখন গ্রামের রাস্তাঘাটে চলতে গেলে পায়ের গোড়ালি অবধি কাদায় বসে যেত। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার পাকা রাস্তাটি তখনও হয়নি। সেই কাদা ডিঙিয়ে, ঝপঝপে জল বৃষ্টিতে ভিজে নবম-দশম শ্রেণির কিশোরীরা চণ্ডীপুর, বেলগ্রাম এবং বড়া, ডোংরা থেকে স্কুলে আসত শাড়ি পরে। ওদের ওই বয়সের বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া লজ্জা, সম্ভ্রম সামলাতে সামলাতে। ভিজে কাপড়েই অতঃপর সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার স্যাঁতস্যাঁতানি। ছাতা থাকলেই বা কী? তাতে হাঁটু পর্যন্ত শাড়ি, সায়া, কিছুটা আঁচল এবং কাঁধ-সংলগ্ন আঁচল ভিজে গিয়ে গায়ের সঙ্গে এমন ভাবে লেপ্টে যেত, যা বয়ঃসন্ধির ছেলে ও মেয়ে, দু’দলের পক্ষেই অস্বস্তিকর। তবে অস্বস্তিটা মেয়েদের ক্ষেত্রে বহুগুণ বেশি। ছেলেদের এক অর্থে পোয়া বারো। কারণ, ছেলেরা ততদিনে স্কুল ফুলপ্যান্ট হলেও জলবৃষ্টিতে সেদিন, আজও, ছেলেরা (এবং প্রায় সমস্ত পুরুষ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী) প্যান্টের পা গুটিয়ে হাফ করে নেয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, শার্ট ভিজে গায়ের সঙ্গে লেগে গেলেও সেটা নিয়ে কটাক্ষ, বাঁকা মন্তব্য বা তারিয়ে দেখার অস্বস্তি থেকে ছেলেরা মুক্ত।

আমাদের পরের প্রজন্ম, আমাদের ছাত্রছাত্রীদের এই সমস্যাগুলি স্বভাবতই গোচরে আসা উচিত ছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ, পুরুষ ও মহিলা শিক্ষকেরা, গ্রামের মাতব্বরদের। কিন্তু, কেউই আমল দেননি। সুতরাং ও-ভাবেই চলছিল।

Advertisement

পরের বছর স্কুলে ভর্তির সময় প্রস্তাব রাখলাম: স্কুলে ক্লাস এইট থেকে টেন পর্যন্ত মেয়েদের ড্রেসকোড বদলানো হবে। তবে, এ রকম সামাজিক ও কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ধর্মীয়-ট্যাবু সঞ্জাত, লিঙ্গ সংক্রান্ত ইস্যুগুলির পরিসরে কামারের এক ঘায়ে ফল উল্টো হতে পারে। তাই মাটি বুঝে বুঝে পা ফেলা। বললাম, ক্লাস এইট থেকে টেন, মেয়েদের স্কুল ড্রেস হবে ঐচ্ছিক সালোয়ার-কামিজ বা শাড়ি। নতুন সেশনে ভর্তি হওয়ার সময় ক্লাস এইট, নাইন ও টেনের ঘরে যে-সব দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা ছিলেন, তাঁদের ঘরে ঘরে গিয়ে খাতায় ছবি এঁকে সালোয়ার কামিজ ও ওড়নার কোনটা কী রং হবে, তা বুঝিয়ে তাঁদের সেটা জনে জনে অবহিত করার অনুরোধ জানিয়েছিলাম।

অবহিত হলেই সেটা তাদের প্র্যাক্টিসে চলে আসবে, এ রকম সরল সমীকরণে গ্রামের জনজীবন চলে না। পুরনো একটা প্রথা ভাঙার কথা বলা হচ্ছিল। কমবয়সি, গ্রামের স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের সুবিধার্থে। সবটা জেনে অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষিকা, অন্যান্য শিক্ষাকর্মী, গ্রামের সাধারণ মহিলা-পুরুষ তদুপরি সংশ্লিষ্ট ক্লাসের সেই সব ছাত্রীরও চোখ-মুখ থমথম করছিল। অথচ তত দিনে কিন্তু এ তল্লাটের গ্রামগুলিতে মেয়েদের দেখছি চুড়িদার (তখনও লেগিংস আসেনি ফ্যাশনে। ওরা সালোয়ার কামিজকেই চুড়িদার বলত) নাইটি বা ম্যাক্সি, এমনকি অল্পবয়সি কেউ কেউ জিন্স টপও পরছে, উৎসব অনুষ্ঠানে। তবে সংখ্যায় এখনকার তুলনায় অনেক কম।

হলেই বা। সেই সব পোশাককে স্কুলের মতো জায়গায় প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা তো দেওয়া হয়নি। তাই হুট করে বিকল্প পোশাকের ছাড় স্কুল দিলেও, সেটা নেওয়ার সময় সকলে সাংঘাতিক দোটানায় ছিলেন।

সত্যিই সময় লেগেছে স্বপ্নটা বাস্তবায়িত হতে। এক জন দু’জন করে মেয়ে এই পোশাক পরে স্কুলে আসা শুরু করল। স্বাচ্ছন্দ্য আসছিল তাদের হাঁটা-চলায়, খেলাধুলোয়। কেউ কেউ যুক্তি দেখাত, যা আংশিক সত্যও বটে, ওদের দিদি বা কমবয়সি মাসি-পিসিরা পাশ করে যাওয়ার পরে তাদের পরিত্যক্ত স্কুলড্রেস শাড়িটি ব্যবহার করতে পারলে তাকে আর নতুন কিনতে হয় না। বলতাম, ‘বেশ তো। ওটা কাটিয়েই না হয় সালোয়ার কামিজ করিয়ে নিস। শুধু দর্জির খরচটুকু লাগবে।’ তাতে কাজ হয়নি। তবে নিয়মটা চালু হওয়ার ক্ষেত্রে তদানীন্তন টিচার-ইন-চার্জের সমর্থন বা প্রকট বিরোধিতা না থাকলেও আমার জন্য অসম্ভব একটা প্রশ্রয় ছিল বলেই সেই পরিবর্তনের কথা ভাবা গিয়েছিল। নিরন্তর লেগে থাকা গিয়েছিল।

আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে যখন দেখি, আমাদের স্কুলের উঁচু ক্লাসের একটা ছাত্রীও আর শাড়ি পরে না, ভীষণ ভরে উঠি। যদিও স্কুলে সরস্বতী পুজোর দিন ছোট থেকে বড়— প্রায় সবাই শাড়ি পরে আসে। বেশ ক’বছর আমাদের স্কুলে খেলার মাস্টারমশাই এসে যাওয়ার পরে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সমানতালে খেলাধুলোয় এগিয়ে এসেছে, ওদের প্রতিটি ক্লাসের জন্য আলাদা আলাদা রঙের খেলার পোশাক নির্দিষ্ট রয়েছে। যেগুলো পরেই ওরা ওদের খেলার ক্লাস করে, স্পোর্টসের সময় শর্টস আর জার্সি পরে লং জাম্প দিতেও আমাদের প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরা আর পিছপা নয়। তুমুল বৃষ্টির দিনে স্কুলের মাঠে জল জমলে এক সঙ্গে ছেলে আর মেয়েরা ফুটবলও খেলে। আছাড় খায়। আবার ওঠে। বিষয়টা অনেক সহজ ও সাবলীল হয়ে এসেছে। নিজেদের ‘আইডেন্টিটি’ নিয়েও তাদের যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছে। স্কুলের সহকর্মীদের মধ্যে ক্রমশ এই পোশাক নিয়ে ‘রিজার্ভেশন’ কমেছে। এলাকার মানুষও পেশার সঙ্গে পোশাকের সম্পর্কহীনতা দিনে দিনে উপলব্ধি করছেন। এক সময়ের বাঁকা মন্তব্য, ভ্রু কুঞ্চন, পুরুষদের অভদ্র, অসঙ্গত প্রশ্ন, মন্তব্য ও জবাবদিহি প্রায় নেই।

সমাজ-নির্মিত যে কাম্য ও স্বীকৃত নারীত্ব, এই লিঙ্গ-নির্মাণের অনেকগুলি বিধি-নিষেধের একটি প্রধান সেক্টর মেয়েদের পোশাক। তার প্রতিফলন রাষ্ট্র-চালিত স্কুল নামক প্রতিষ্ঠানেও বলবৎ। স্কুলে লক্ষ্য করছি সেভেন, এইট, এমনকি সিক্সের মেয়েরাও স্কার্ট-ব্লাউজ় পরছে ঠিকই কিন্তু প্রত্যেকে নানা রঙের পা ঢাকা লেগিংস পরে আসছে শীত-গ্রীষ্ম ঋতু নির্বিশেষে। একই বয়সি ছেলে ও মেয়ের জন্য পোশাকের বিধি পাল্টে যাচ্ছে এই একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে খোদ রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীতে, তাঁর আদরের পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রে।

অশ্লীলতার যুক্তি-প্রতিযুক্তির তর্কে না গিয়ে সহজ জিজ্ঞাসা, তা হলে মুখ থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা মধ্যপ্রাচ্যের আপামর নারী-সমাজের হাজার বছর আগের প্রবর্তিত ড্রেসকোড হিজাব কী দোষ করল? অথবা একশো দেড়শো বছর আগে এই বাংলার হিন্দু কুলীন ঘরের বালিকা থেকে প্রৌঢ়া মেয়ে-বৌদের যে একগলা ঘোমটা টেনে রাস্তায় হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়ে কৌলিন্য রক্ষা করতে হত, তারই বা রদবদলের কী প্রয়োজন ছিল?

মনে পড়ছে ঠাকুরবাড়ির নারীদের কথা। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী আপামর ভারতীয় নারীরা যে ভাবে আজ শাড়ি পরেন, (দাক্ষিণাত্যে ধুতির মতো করে শাড়ি পরা তাদের প্রাদেশিক বৈশিষ্ট) সেটা শিখিয়েছিলেন। এতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসা নারীর ব্যক্তিত্বটি সম্পূর্ণ প্রকাশ পায়। রামমোহন রায়, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগরের হাত ধরে নারীরা অন্দরমহল থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন তো একটা মুক্ত আকাশের তলায় দাঁড়াবেন বলেই। সেই বেরিয়ে আসার পথটি সুগম করার পরিবর্তে সমাজ পদে পদে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। নারী তো শুধু আবৃত আর অনাবৃতের ছকেই বাঁধা নয়, নারী হল কবির অর্ধেক আকাশ। সেই আকাশের হাঁটু, গ্রীবা, বাহুমূল কিংবা ক্লিভেজই যদি হয়, অনাবৃত থেকে গেলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে কার? সমাজের? তাই কি স্কুলের গণ্ডী থেকেই এমন ‘আবৃত’ বা অপ্রকাশিত থাকার পাঠ? এমন অসুস্থ সমাজ টিকিয়েই বা কী হবে?

লেখক স্কুলশিক্ষিকা ও সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন