একটি জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।—ফাইল চিত্র।
ব্যাঙ্কে ভিড়। এটিএমে লাইন। তার মধ্যেই নতুন সমস্যা, কাজের তোড়ে বসে গিয়েছে টাকা ছাপানোর মেশিন!
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, এ বছরের মধ্যে নোট বাতিল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। পরে সুর বদলে বললেন, বর্ষ শেষের পর সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক সূত্রে অবশ্য জানা গিয়েছে, এই মুহূর্তে দেশের চারটি টাকা ছাপানোর যন্ত্রের মধ্যে দু’টির অস্থায়ী ‘ব্রেকডাউন’ হয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছে, এই পরিস্থিতিকে বলা হয় মেটালিক ফ্যাটিগ বা যান্ত্রিক ক্লান্তি। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রককে সে কথা জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নিযুক্ত ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট দলের জরুরি ফরমান ছিল, চব্বিশ ঘণ্টা ধরে টাকা ছাপার সব যন্ত্র চালু রাখতে হবে। নোট ছাপাতে হবে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। এই মুহূর্তে এ দেশে টাকা ছাপানোর যন্ত্র আছে মোট চারটি। মহারাষ্ট্রের নাসিক, ভোপালের কাছে দেওয়াস, পশ্চিমবঙ্গের শালবনি এবং কর্নাটকের মহীশূরে। বিভিন্ন নোটের প্রকৃতি অনুসারে প্রতি দিন নোট ছাপানোর একটি সুনির্দিষ্ট সংখ্যা রয়েছে। তার বেশি ছাপা যায় না।
বাজার থেকে ইতিমধ্যেই প্রায় ১৪ লক্ষ কোটি টাকা উঠে এসেছে। কিন্তু, নতুন নোট এখন পর্যন্ত ফিরে এসেছে ৬ লক্ষ কোটি। প্রথম দিকে সরকার বলার চেষ্টা করেছিল, ইচ্ছাকৃত ভাবেই নোটের ঘাটতি রাখা হচ্ছে যাতে মনস্তাত্ত্বিক ভাবে মানুষ ‘ক্যাশলেস’ বা ‘লেস ক্যাশ’ অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে। কিন্তু, গত দু’সপ্তাহে নোটের অভাব এ দেশে যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করেছে তাতে প্রধানমন্ত্রীর প্রধান ক্রাইসিস ম্যানেজার রাজস্ব সচিব হাসমুখ আঢ়িয়া রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে নির্দেশ দিয়েছেন, অবিলম্বে টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়তে হবে। না হলে অর্থনীতি বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই ফরমানের ফলে দু’শিফটের পরিবর্তে চার শিফটে টাকা ছাপতে হচ্ছে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে সাম্প্রতিকতম বিপদ যেটা হয়েছে তা হল, দু’টি যন্ত্র অচল হয়ে পড়েছে।
গা-জোয়ারি এই নির্দেশ মান্য করার জন্য আরবিআই গর্ভনর উর্জিত পটেল অধস্তনদের নির্দেশ দিচ্ছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যন্ত্রেরও বিশ্রাম প্রয়োজন। ২০০০ টাকার নোট ছাপানোর পরে অন্তত ২১ দিনের বিরতি দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেই বিরতি না দিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপে দ্রুত পাঁচশো টাকা ছাপানোর কাজে হাত দিতে হয়েছিল টাঁকশালগুলিকে। নাসিক ও দেওয়াসের টাকা ছাপানোর যন্ত্র কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের অধীনে। আর শালবনি ও মহীশুরের যন্ত্রগুলি ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মুদ্রণ প্রাইভেট লিমিটেডের হাতে। আরবিআইকে তারা জানিয়েছিল, টাকা ছাপার জন্য বিরতি দেওয়া খুবই জরুরি। এতে ছাপার মান ঠিক থাকবে।
দিন পনেরো আগে নোট ছাপানোর সরঞ্জাম আমদানি করা নিয়েও ঝামেলা হয়েছিল। সুইৎজারল্যান্ডের একটি সংস্থার থেকে নোট ছাপার কাগজ আমদানি হয়। তারা ভারতকে জানিয়েছিল, অল্প সময়ে এত কাগজ পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। ২০১৫ সালে সংস্থাটি কালো তালিকাভুক্ত হয়েছিল। কিন্তু, কাগজের আমদানির জন্য মোদী সরকার সেই সংস্থাকেই বেছে নিয়েছে। সংস্থাটি অবশ্য পরে জানিয়েছে আগামী ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যেই তারা আবার কাগজ পাঠাতে পারবে।
সব মিলিয়ে টাকা ছাপানো নিয়ে নর্থ ব্লকে যে নৈরাজ্য চলছে এমনটা কোনও দিন দেখেননি বলে জানাচ্ছেন প্রবীণ এক আমলা। সঙ্কটের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে পরস্পরকে দোষারোপ করছে। আরবিআইয়ের শীর্ষ আর্থিক উপদেষ্টারাও উর্জিত পটেলের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছেন। আরবিআইয়ের এক শীর্ষ কর্তার মন্তব্য, ‘‘গর্ভনরের জো হুজুর হওয়া উচিত হয়নি। নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত ভাল, কিন্তু কোনও প্রস্তুতি না নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত অর্থ ব্যবস্থায় বিপদ ডেকে এনেছে।’’ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একটি সূত্র জানাচ্ছে, অক্টোবর থেকে ২০০০ টাকার নোট ছাপা শুরু হয়। সিদ্ধান্ত ঘোষণা হয়েছে ৮ নভেম্বর। তাঁর মতে, সরকারের শীর্ষ কর্তাদের বোঝা উচিত ছিল যে এত কম সময়ে এত টাকা ছাপার ক্ষমতা তাদের নেই। এ দিকে ব্যাঙ্ক কর্মীরা ক্ষিপ্ত হয়ে আরবিআই ঘেরাও করছেন। তাঁরা বলছেন, অপরাধী ব্যাঙ্ককর্মীদের শাস্তি দেওয়া হোক। কিন্তু ব্যাঙ্কের কাছে যথেষ্ট টাকার জোগান না থাকলে ব্যাঙ্কের চলবে কী করে!
শুধু অর্থ মন্ত্রকের কিংবা আরবিআইয়ের শীর্ষ অফিসাররাই নয়, পরিস্থিতি যে ভাবে এগোচ্ছে, তাতে চরম অস্বস্তিতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। কেননা, নোট বাতিল নিয়ে মানুষের ভোগান্তির মধ্যেই সরকারের বিভিন্ন দফতর, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের শীর্ষ কর্তাদের মধ্যে দশ রকমের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যেই অর্থ মন্ত্রকের অফিসারদের একাংশের বক্তব্য, রাজস্ব সচিব হাসমুখ আঢ়িয়া, উর্জিত পটেলের সঙ্গে মিলে গোপনীয়তা রক্ষা করেছেন ঠিকই। কিন্তু, পাঁচশো টাকা কেন নভেম্বর মাসে ছাপা শুরু হল? আগে ছাপাতে কী অসুবিধা ছিল?
এখন টাকা ছাপার মেশিন বসে গিয়ে চরম সঙ্কট তৈরি হওয়ায় আরবিআইয়ের কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, যত পরিমাণ টাকার প্রয়োজন তা ছাপিয়ে বিদেশ থেকে নিয়ে আসা হোক। গম আমদানি করতে যদি সমস্যা না থাকে, তা হলে টাকা ছাপিয়ে আনতেই বা সমস্যা কোথায়!। কিন্তু, সরকারের শীর্ষ মহলে এ নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন, কিন্তু ভারতের মতো দেশ বাইরে থেকে টাকা ছাপিয়ে আনলে রাজনৈতিক ভাবে সমস্যা হবে। কেন না, বিরোধীরা ছেড়ে কথা বলবে না।
নরেন্দ্র মোদীর জন্য এটাই বোধহয় ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’ অবস্থা। কারণ, তাঁর প্রতিশ্রুতির পরেও নতুন বছরের শুরুতে ঠিক ভাবে টাকা জোগানের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। অথচ বিদেশ থেকে টাকা ছাপিয়ে আনতেও চরম দ্বিধার মধ্যে রয়েছে সরকার।