বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো কাহাকে বলে, দেখিল বটে রাজ্যবাসী। মেডিক্যাল কলেজ স্বীকৃতি পাইবার শর্ত উত্তরোত্তর জটিল হইয়াছে, ডাক্তারির প্রবেশিকা কঠিন এবং পাঠক্রম দীর্ঘ হইয়াছে। কিন্তু ‘ডাক্তার’ হইতে পারা অতি সহজ। একটি নকল সার্টিফিকেট জোগাড় করিলেই যথেষ্ট। ভুয়ো ডাক্তার ধরিবার অভিযানে নামিয়া এখন থই মিলিতেছে না পশ্চিমবঙ্গ মেডিক্যাল কাউন্সিলের। কর্পোরেট হাসপাতাল হইতে পাড়ার ঔষধের দোকানে চেম্বার, সরকারি হাসপাতালের আউটডোর হইতে স্বাস্থ্যবিমা কোম্পানির দফতর, সর্বত্রই মাকাল মিলিতেছে। ভুয়ো ডাক্তারের সংখ্যা কয়েক শত হইতে কয়েক সহস্রে পৌঁছাইয়াছে। তাহার সহিত বাড়িতেছে প্রশ্নও। কী করিয়া এত প্রতারক এতগুলি হাসপাতালে এত দিন চিকিৎসা করিল? চিকিৎসকের শংসাপত্র-সহ অন্যান্য দাবিগুলি মিলাইয়া দেখিবার কোনও বিধিব্যবস্থা কি হাসপাতালে নাই? থাকিলে তাহা কী করিয়া এত ত্রুটিপূর্ণ হইতে পারে? সৎ ও স্বচ্ছ ব্যবস্থা কি চিকিৎসা পরিষেবার প্রাথমিক শর্ত নহে? মেডিক্যাল কাউন্সিলের দাবি, তাহাদের ওয়েবসাইট হইতে রেজিস্ট্রেশন বিষয়ক সকল তথ্য মিলিবে। তবে কি সেই তথ্যে ফাঁক রহিয়াছে? নাকি মিলাইয়া দেখা হয় নাই? মেডিক্যাল কাউন্সিল সমস্ত ডাক্তারকে পুনরায় রেজিস্ট্রেশন করাইতে বলিয়াছে। তাহাতে বর্তমানে কর্মরত নকলনবিশদের হয়তো ধরা যাইবে। কিন্তু যে সকল অসাধু ব্যক্তি চিকিৎসক সাজিয়া পূর্বে কাজ করিয়া গিয়াছেন?
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির ফলে অতীতে কত রোগীর ক্ষতি হইয়াছে, তাহা কে বলিতে পারে? সংবাদে প্রকাশ, তেমন এক চিকিৎসকের অপচিকিৎসায় পা হারাইতে হইয়াছে এক আহত ব্যক্তিকে। এই সব রোগীর ক্ষতি পূরণ অসম্ভব। ভুয়ো ডাক্তারের সংখ্যা, এবং তাহাদের কারও কারও দীর্ঘ দিনের কাজের অভিজ্ঞতা স্পষ্টই ইঙ্গিত দিতেছে যে সমস্যাটি পুরাতন এবং ব্যাপক। বস্তুত, জাল চিকিৎসা কারবারের সবটাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অজ্ঞাতসারে হইয়াছে, এই দাবিটিও পরীক্ষার প্রয়োজন রহিয়াছে। বেসরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিং হোমগুলিতে ‘মেডিক্যাল অফিসার’-এর অভাব যথেষ্ট, চাহিদা অনুসারে এমবিবিএস ডাক্তার জোগানো কঠিন। সরকারি হাসপাতালেও বহু পদ ফাঁকা পড়িয়া রহিয়াছে, তাহা সর্বজনবিদিত। সেই সকল ফাঁক মিটাইতে কর্তারা নিয়োগে শিথিলতা দেখাইতেছেন কি না, তাহারও অনুসন্ধান প্রয়োজন।
একটি কাগজ জাল করা কঠিন নহে, কিন্তু যে সকল দক্ষতা লইয়া চিকিৎসকেরা কাজ করিতে আসেন, প্রশিক্ষণহীন ব্যক্তির পক্ষে তাহার হুবহু অনুকরণ কি সম্ভব? তাঁহাদের সহিত দীর্ঘ দিন কাজ করিয়াও সহকর্মীরাও কি টের পান নাই তাঁহাদের জ্ঞান ও দক্ষতার নমুনা? আর যদি প্রশিক্ষিত এবং অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তির কাজে পার্থক্য না-ই থাকে, তাহা হইলে এত কঠিন ডাক্তারি পাঠক্রমের প্রয়োজনই বা কী? দামি হাসপাতালে উচ্চপদে আসীন চিকিৎসকদের মধ্যেও প্রতারক মিলিয়াছে। ইহাতে গোটা চিকিৎসাব্যবস্থার উপরেই অনাস্থা আসিয়া পড়া অবধারিত। ডাক্তার জাল হইলে নার্স বা টেকনিশিয়ানও হইতে পারে। নকল প্যাথলজিস্ট জাল রিপোর্ট দেন, তাহা দেখিয়া জাল ডাক্তার ঔষধ লেখেন, জাল ফার্মাসিস্ট তাহা বিক্রয় করেন। এই কি আমাদের চিকিৎসার স্বরূপ? কতিপয় প্রতারককে শাস্তি দিয়া এই উদ্বেগ প্রশমিত হইবে না। মেডিক্যাল কাউন্সিল, স্বাস্থ্য দফতর, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাহাদের কর্তব্যে কেন ব্যর্থ, তাহার অনুসন্ধান প্রয়োজন। কেন তাঁহারা সুরক্ষিত চিকিৎসা নিশ্চিত করিতে পারেন নাই, তাহার জবাবদিহি করিতে হইবে। প্রতারক এবং প্রতারণায় প্রশ্রয় যত বাড়িবে, আস্থার পরিধি ততই সংকুচিত হইবে। তাহাতে সমাজে আরও অসহিষ্ণুতা এবং হিংসা বাড়িবে।