মোদী জানেন, নির্বাচনী সাফল্যের জন্য নাগপুরকে পাশে চাই

সংঘের নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে

নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন পর আবার দ্বিতীয়বারের জন্য ওই আরএসএস নেতাটির সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজনের সুযোগ হয়।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share:

নেতৃত্ব: স্বেচ্ছাসেবকদের কুচকাওয়াজ দেখছেন মঞ্চে আসীন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত ও অন্যান্য নেতা, নাগপুর, বিজয়া দশমী। ছবি: পিটিআই

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের মুখে আরএসএস-এর এক শীর্ষ নেতা মধ্যাহ্নভোজনে আমন্ত্রণ জানান। আমরা তিন-চার জন সাংবাদিক ছিলাম। সে দিন প্রশ্ন করেছিলাম, নরেন্দ্র মোদীকে আপনারা প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে কি হৃদয় থেকে মেনে নিয়েছেন? গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আপনাদের অঙ্গুলি হেলনে চলেননি। প্রধানমন্ত্রী হয়ে কি তিনি চলবেন? নিরামিষ ভোজনরত মরাঠি নেতা গোঁফের ফাঁকে মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘গোটা দেশে এখন মোদীই হিন্দুত্বের প্রতীক। পুরো দেশের মুডটাই এমন যে অন্য কাউকে ভাবাই অসম্ভব।’

Advertisement

কিন্তু নিতিন গডকড়ী, রাজনাথ সিংহ, এঁরাও তো আরএসএস, মোদীও তাই। তবে নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ন্ত্রণ করতে অাপনারা হিমশিম খান কেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, একটা কারখানা থেকে একই গাড়ি বেরোয় লক্ষ-লক্ষ। কিন্তু কোনও কোনও গাড়ির মেনটেনেন্স ও সার্ভিসিং খরচ অন্য গাড়িগুলির চেয়ে বেশি। যন্ত্রের ক্ষেত্রে যদি এটা হয়, তবে মানুষের ক্ষেত্রেও তো সেটা হতে পারে। আরএসএস ঘনিষ্ঠ নেতা সঞ্জয় জোশী, যার আপত্তিজনক ভিডিয়ো ফুটেজ নিয়ে মুম্বইয়ের দলের কর্মসমিতির বৈঠকে বিরাট হইচই হয়েছিল। গুজরাতের তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সঞ্জয় জোশীর সঙ্গে কলহ বহু আলোচিত। মুম্বই বৈঠকে সে বার এক দিকে যেমন আডবাণীর ইস্তফা ছিল বিজেপির ইতিহাসে এক সন্ধিক্ষণ, তেমনি সঞ্জয় জোশীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণও ছিল এক বড় ঘটনা। সে দিন আরএসএসের সেই বিশিষ্ট নেতাকে এক তামিল সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, সঞ্জয় জোশীর বিরুদ্ধে যে ভাবে মোদীজি জিহাদ ঘোষণা করেছেন তাতে কি সংঘ খুশি? মোদীর তুলনায় সঞ্জয় জোশী তো খুবই নগণ্য। তা হলে মশা মারতে কামান দাগা কেন? সংঘ নেতা যা বলেছিলেন তার মর্মকথা আসলে মোদীর প্রকৃতির মধ্যে রজোগুণ আছে। নাকে একটা মাছি বসে বিরক্ত করলে তরবারি দিয়ে মাছিশুদ্ধ নাকটাই কেটে ফেলতে পারেন তিনি।

নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন পর আবার দ্বিতীয়বারের জন্য ওই আরএসএস নেতাটির সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজনের সুযোগ হয়। তখন দেখলাম, ওই নেতাটি মোদীর কাজকর্মে খুবই প্রীত। তিনি বলেছিলেন, নেহরু-গাঁধী অহিংসা-ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের নামে এক ‘মিথ’ তৈরি করেছিলেন। এর ফলে দশকের পর দশক কংগ্রেসের শাসনে রাষ্ট্র দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে। এ বার মোদীর নেতৃত্বে এক শক্তিশালী হিন্দু রাষ্ট্র গঠনই আমাদের লক্ষ্য। এই হিন্দুত্ব মানে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ।

Advertisement

তিন বছর অতিবাহিত। বিজেপির সঙ্গে আরএসএসের সম্পর্কের সর্বশেষ পরিস্থিতি কী?

অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে রজ্জু ভাইয়া এবং কে সুদর্শনের সঙ্গে বিজেপি তথা বাজপেয়ীর যে সংঘাত হয়েছিল, মোদীর সঙ্গে তা হয়নি। এ কথা সত্য হিন্দুত্ব ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে সংস্কৃতি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সংঘকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রশ্নে, কয়েকশোগুণ খুশি মোহন ভাগবত। কিন্তু আর্থিক প্রশ্নে? বিশেষত, নোট বাতিল ও জিএসটি এই দুটি বিষয়েই আরএসএসের সঙ্গে মোদী কোনও আলোচনা করেননি। তাই আরএসএস খুবই ক্ষুব্ধ। তিন বছর পর বিজয়া দশমীর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে মোহন ভাগবত প্রকাশ্যে ক্রমবর্ধমান সমস্যার কথা তুলে ধরেন।

আসলে এই পারস্পরিক সম্পর্কটিতে অনেক স্তর আছে। সম্পর্ক ভাল অথবা খারাপ, এক কথায় সাদা-কালোয় জবাব হয় না। সত্য নিহিত ধূসরতায়। হিন্দুত্বের ‘পোস্টার-বয়’ আজও নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু শুধু হিন্দুত্বের প্রেক্ষিতে আরএসএস বিজেপি সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করা ভুল। আর্থিক সংস্কার, শ্রম সংস্কার এই সব অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে বাজপেয়ী সরকারের সঙ্গেও যে ভাবে সংঘাত বেধেছিল সুদর্শনের, আজও তা ঠিক একই ভাবে অব্যাহত। এর পিছনে বাস্তবকেও মনে রাখতে হবে। গোটা পৃথিবী যখন আর্থিক সংস্কারের আধুনিক গতিপথ ধরে এগোচ্ছে, সেই সময়ে কমিউনিস্টদের মতো আরএসএস-ও বহু বিষয়ে পশ্চাদমুখী প্রবণতায় আক্রান্ত। ফলে সংঘাত অনিবার্য। বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে এই বিরোধ বাড়ে।

তা ছাড়া সবটাই যে নীতির প্রশ্ন, তা নয়। অধুনা সরকার ও দলের উপর আরএসএস-এর নিয়ন্ত্রণও বড় প্রবল হয়ে উঠেছে। ১৯২৫ সালে হেডগেওয়ার যখন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা করেন তখন এটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জনসংঘ গঠনের সময়েও বিতর্ক কম হয়নি। পরে জরুরি অবস্থার সময় জয়প্রকাশ নারায়ণের হাত ধরে আরএসএস রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হয়।

১৯৮০ সালের ৫ এপ্রিল বিজেপির যখন জন্ম হল, তখন আরএসএসের বাইরে থাকা নেতাদের প্রবেশও বাড়তে থাকে দলে। জনসংঘ ও বিজেপির রাজনীতিতে জোট বাধ্যবাধকতা হিন্দুত্বের মতাদর্শ থেকে দলকে সরিয়ে দিচ্ছে এ অভিযোগ ওঠে সংঘে। বিমার বেসরকারিকরণ বা বিদেশি বিলগ্নিকরণের কথা ভাবা যেতে পারে। বাজপেয়ী সরকারের সঙ্গে সুদর্শনের প্রবল বিবাদ হয়েছিল এ নিয়ে। ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডে এসে আরএসএস নেতারা বৈঠক করে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন বাজপেয়ীর। এক দিকে জোটের বাধ্যবাধকতা, অন্য দিকে সংঘ, বাজপেয়ী পড়েছিলেন ঘোর বিপদে।

মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায়। ফলে মোহন ভাগবতের প্রচার ও প্রাসঙ্গিকতা বেড়েছে। নাগপুরের বিজয়া দশমীর লাইভ টেলিকাস্ট বাজপেয়ীর আমলেও হয়নি। এখন তো চ্যানেলে-চ্যানেলে ভাগবত পরিদৃশ্যমান। তবে, নাগপুর সম্পর্কে প্রকাশ্যে গদগদ ভাবটা বেশি হলেও সরকার চালাতে কিন্তু মোদী মোহন ভাগবতের সঙ্গে কোনও দৈনন্দিন পরামর্শ করেন না। এ দিকে নাগপুর চায় মোদী সরকারের প্রকৃত নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে, যা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। এতে মতাদর্শের চেয়েও ক্ষমতার রাজনীতি বেশি। এখানেই সম্পর্কের জটিলতা।

মোদী-অমিত শাহ জানেন, নির্বাচনী রাজনীতির দলীয় সাফল্যের জন্য আরএসএস-কে চাই। তাই হিন্দুত্ব এবং পাক সন্ত্রাস, দীনদয়াল উপাধ্যায় এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ লোকসভা ভোটের আগে এই সমীকরণগুলি বাড়াতেই হবে। আর্থিক সংস্কারের জন্য, আধুনিক ভারত গঠনের জন্য মোদী অনেক ব্যাপারেই আরএসএসের পশ্চাদমুখী অবস্থানকে অবজ্ঞা করতে চেয়েছিলেন। তিন বছর মানুষের অসন্তোষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরএসএস-এর নিয়ন্ত্রণও বাড়তে দেখা যাচ্ছে। এত দিন মোদীর কথা শুনতে হয়েছে মোহন ভাগবতকে, এ বার কি মোহন ভাগবতের কথা শুনতে বাধ্য হবেন মোদী?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন