ইতিহাসের ‘অশ্রুজল’

বিজেপির দ্বন্দ্বটি স্পষ্ট: বাবরি মসজিদের মতো করিয়া তাজমহলের নিষ্পত্তি যদি সহজ না হয়, তবে বরং হিন্দু মন্দির হিসাবে তাহাকে ‘অধিকার’ করা জরুরি। যাহা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়, তাহা হইল একটি মুসলিম স্থাপত্য লইয়া দেশ-দুনিয়ার এতখানি আদেখলাপনা। তাজমহল দেশের সাংস্কৃতিক প্রতীক না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share:

প্রশ্নটি সরল। বস্তুটিকে ভাঙিয়া ফেলা হইবে, না কি আস্ত রাখিয়াই ‘গোপন’ তথ্য উদ্ঘাটন করা হইবে? তাই, এক দিকে বিজেপি বিধায়ক সংগীত সোম বলিতেছেন, তাজমহল ভারতীয় সভ্যতার বৃহত্তম কলঙ্ক, এবং ঠারেঠোরে উসকানি দিতেছেন, সেই কলঙ্ক সমূলে উৎপাটনের। অন্য দিকে বিজেপি নেতা বিনয় কাটিয়ার ঘোষণা করিতেছেন, তাজমহল আসলে তেজোমহল নামে একটি হিন্দু মন্দির, যাহা দখল করিয়া শাহজাহান তাঁহার পত্নীর সমাধি তৈরি করেন। বিজেপির দ্বন্দ্বটি স্পষ্ট: বাবরি মসজিদের মতো করিয়া তাজমহলের নিষ্পত্তি যদি সহজ না হয়, তবে বরং হিন্দু মন্দির হিসাবে তাহাকে ‘অধিকার’ করা জরুরি। যাহা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়, তাহা হইল একটি মুসলিম স্থাপত্য লইয়া দেশ-দুনিয়ার এতখানি আদেখলাপনা। তাজমহল দেশের সাংস্কৃতিক প্রতীক না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু প্রতীক যদি হইতেই হয় তবে অবশ্যই তাহাকে ‘ধর্মান্তরিত’ হইয়া হিন্দু হইতে হইবে, অর্থাৎ সংঘ-মতে ‘জাতীয়’ হইতে হইবে। হিসাবটি সহজ। রামমন্দির সভা উত্তরপ্রদেশে এখন দ্রুতবেগে বর্ধমান, তাহার সামনে এই সব অগ্নিবর্ষী তাজমহল-তত্ত্ব শ্রুত হইতেছে। সভায় অংশগ্রহণকারী গৈরিক ফেট্টিশোভিত সংঘীয় জনতা নিশ্চিত, তাঁহারাই এখন তাজমহলের ‘গোপন’ ও ‘সত্য’ ইতিহাসটি জানেন, বাকি দেশবাসী তিনশত বৎসর সম্পূর্ণ ভুল জানিয়া আসিয়াছেন।

Advertisement

২০১৭ সালের ভারত পৃথিবীর সামনে একটি দাবি তুলিয়া ধরিতেছে: তাহাই ইতিহাস যাহা রচিবে সংঘ। তাই তেজোমহল বিষয়টি পুরাতন মতে ঐতিহাসিক কি না, এই সংশয় তুলিবার বোধহয় জায়গা নাই। রামচন্দ্র গুহের মতো ইতিহাসবিদ কিংবা গৌরী লঙ্কেশের মতো সাংবাদিক সে সব প্রশ্ন তুলিলে মানহানির মামলা কিংবা প্রাণহানির অস্ত্রই এখন দস্তুর। সুতরাং, এ সব তথ্য আর আলোচনায় কাজ নাই যে— তেজোমহল বস্তুটির উল্লেখ কোনও মান্য ইতিহাসে নাই, ১৯৮৯ সালে পি এন ওক নামে এক বিতর্কিত স্বঘোষিত ‘ইতিহাস-জ্ঞানী’ এমন একটি দাবি তুলিয়া বই লিখিয়াছিলেন। সমতুল্য আরও কিছু দাবি তিনি তুলিয়াছিলেন, যেমন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে পূর্বে একটি শিবমন্দির ছিল। এত দূরই তর্কটি গিয়াছিল যে ২০০০ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কেবল তেজোমহল নস্যাৎ হয় নাই, তাহার দাবিদারও বদ্ধ উন্মাদ বলিয়া বিবেচিত হইয়াছিলেন!

সতেরো বৎসর অনেক সময়, পরিস্থিতি অনেক পরিবর্তিত। বিজেপি তথা সংঘের দেশব্যাপী ক্ষমতাবিস্তারের সূত্রে দীনদয়াল উপাধ্যায় বা পি এন ওকের মতো ‘পণ্ডিত’রাই এখন গতি। এই পরিবর্তিত দেশে তাজমহলের ভবিষ্যৎ মোদী ও যোগীদের কৃপার উপর, এবং অবশ্যই ভোটের হিসাবের উপর, নির্ভর করিতেছে। জনতার সামনে সংগীত সোমের তাজমহল-গালাগালির বন্যার সহিত কি উত্তরপ্রদেশ পুরনির্বাচনের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ নাই? অতি কট্টর জনতাকে কাছে টানিবার জন্য যদি সোম থাকেন, মাঝামাঝি কট্টরদের জন্য আছেন যোগী। তিনি সোমকে ঈষৎ ভর্ৎসনা করিয়া শীঘ্র তাজমহল-সফরে যাইতেছেন, যদিও তিনি মনে করেন, উহাকে পর্যটক-কেন্দ্র হিসাবে গুরুত্ব না দেওয়াই উচিত। রক্ষণশীলতার বিভিন্ন বিন্দুতে বিভিন্ন অবস্থান গাড়িয়া ভোট আকর্ষণ, ইহাই বিজেপির স্ট্র্যাটেজি। ইহাই তাজমহলের নিয়তি।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন