Coronavirus

গুজব থেকেও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন

সঙ্কটকে কখনও আতঙ্ক দিয়ে মোকাবিলা করা যায় না, সচেতনতা, সাহস ও স্বাস্থ্য-পরিষেবাই শেষ কথা, তাই সুরক্ষার দিকে মনোনিবেশ করা জরুরি।আসলে বিপুল সংখ্যার মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতাবোধ এমনই। এদেরই ভোটে শ্রেষ্ঠ গণতন্ত্রের ইমারত দাঁড়িয়ে। এঁদের অজ্ঞতা ও অসচেতন মানসিকতা পরিবর্তনের প্রধান শিক্ষক সেই সরকারই।

Advertisement

জিনাত রেহেনা ইসলাম

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২০ ০৪:৫৭
Share:

কোভিড-১৯ আতঙ্কে বিশ্ব কাঁপছে। দেশেও মহামারি ঘোষিত। এক দিকে বাড়ছে উদ্বেগ। অন্য দিকে সতর্কতার নানাবিধ পরামর্শ। তাতে কী! উত্তরবঙ্গগামী স্টেট বাসে ভর দুপুরে মুখে রজনীগন্ধা গুটকা ও অন্য হাতে তুলসি জর্দা নিয়ে বেদম সুখে মুখ নাড়ছেন এক যুবক। মাঝে মাঝেই গলা বের করে থুতু ফেলছেন বাসের জানালা দিয়ে। করোনার বিষয়ে প্রশ্ন করায় সহজে জবাব দিলেন, ‘‘জানালা খুলে রাখা ভালো। ভাইরাস চলে যায় !’’ আবার, শহরে প্রয়োজনে আসা বেলডাঙার এক কিশোর অটোচালককের কাছে পয়সা ফেরত নিতে গিয়ে বলছে, ‘‘টাকায় ভাইরাস আছে, আমাকে পয়সা দিন।’’ দৌলতাবাদের এক ব্যবসায়ী অনায়াসেই করোনার জ্ঞান জাহির করছেন, ‘‘বাইরের বাতাসের রোগ, এখানে কি হবে? পোল্ট্রি খাওয়া বন্ধ করেছি আমরা।’’

Advertisement

আসলে বিপুল সংখ্যার মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতাবোধ এমনই। এদেরই ভোটে শ্রেষ্ঠ গণতন্ত্রের ইমারত দাঁড়িয়ে। এঁদের অজ্ঞতা ও অসচেতন মানসিকতা পরিবর্তনের প্রধান শিক্ষক সেই সরকারই। আজ কঠিন পরীক্ষার সামনে বেরিয়ে পড়ছে সরকার নিয়ন্ত্রিত মেশিনারির সীমাবদ্ধতার কথা। স্বাস্থ্যপরিষেবার দুর্বলতাকে আড়াল করে তৎপরতা ও নিয়ন্ত্রণ বিধির জোর চালু। ভয়ের বাজার সরগরম। মানুষের সামনে একচিলতে সম্ভাবনার আলো কেউ জ্বালতে পারছে না। শেষমেশ গৃহবন্দি হয়ে থাকাকেই আপাত প্রতিষেধক মেনে নিয়েছে মানুষ। আক্রান্তের মৃত্যুভয়। আক্রমনের বাইরের থাকা মানুষের সংক্রমনের ভয়। এই অভিঘাতে দাঁড়িয়ে অবিচল আয়ুরেখা।

এত কোটি মানুষের দেশে বিপদের দিনে প্রাথমিক ভাবে সরকারের হাত থেকে দুটি ব্রহ্মাস্ত্র বেরিয়ে এসেছে। এক সেফ হ্যান্ড চ্যালেঞ্জ ও অন্যটি কোভিড -১৯ সলিউসন চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতা। হাত ধুলেই মানুষ বাঁচবে? সাহায্যের প্রতিশ্রুতিতে মোবাইলের প্রতি কলে নষ্ট হচ্ছে পাক্কা ত্রিশ সেকেন্ড। হেল্পলাইন নাম্বারে ফোন করে কি পাওয়া যাচ্ছে? কাছাকাছি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগের পরামর্শ। সংগৃহীত সেই কাশি শিষ্টাচারবোধ এমন অতিসতর্কতার আকার নিয়েছে যে মানুষ পথে–ঘাটে স্বাভাবিক ভাবে হাঁচতে ভয় পাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অন্যরা আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষার আশ্রয় নিচ্ছেন। ফ্যানের হাওয়ায় ঠান্ডা লেগে সামান্য সর্দি আক্রান্ত মানুষও ভয় পাচ্ছে যে তাঁকে করোনার শিকার ভেবে বিচ্ছিন্নতার ঠিকানায় না পৌঁছে যেতে হয়। তাই অসুখ গোপনের ঝুঁকি থাকছেই। রোগ আক্রান্ত না হতেই স্বেচ্ছায় একাকী হচ্ছেন একদল মানুষ। যারা ঘোষিত করোনা শিকার তারা আবার পালানোর চেষ্টা করছে যানবাহন চড়ে। রোগ ছড়িয়ে দেওয়ার এক শিহরণ জাগানো বিকৃত আনন্দের উৎসব চারদিকে। আক্রান্তদের গণতান্ত্রিক আস্থা, সাধারণ জ্ঞান এবং বিশ্বাসের রুটিন বদলে গেছে। আচরণবিজ্ঞান অনুসারে, নিশ্চিত ভয় এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিক্রিয়াতে স্নায়বিক পরিবর্তন ও অন্যরকম সজাগতা ও ধ্বংসাত্মক ব্যাবহারের দিকে পরিচালিত করতে পারে।

Advertisement

এই আতঙ্ক সৃষ্টির দায় সরকার ও মিডিয়ার। দেশের ফার্মা কোম্পানি, বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের এক্ষেত্রে চুপ করে থাকা মারাত্মক। সরকারের তাদের বেশি সক্রিয়তার সঙ্গে কাজে লাগানোর কথা।

অনিয়ন্ত্রিত সংক্রামক রোগে বড় হাতিয়ার স্বাস্থ্য নির্দেশিকা। এ বারে নিজে সতর্ক থেকেও রেহাই নেই। বাকিরা সতর্ক থাকছে কি না তার উপরই নির্ভর করছে জনের জীবন ও পরিবার। জনস্বাস্থ্য দপ্তর ও আধিকারিকরা ধরে নিচ্ছেন যে, তাদের বক্তব্য ও সতর্কতার গুচ্ছ নির্দেশাবলী জনগণের কাছে পৌঁছলে খানিক নিশ্চিত হয়া যাবে। বাস্তবে কিন্তু শ্রোতাদের কাছে এগুলির আলাদা ভাবে বিশদ ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। যোগাযোগকারী হিসাবে যে নম্বর দেওয়া থাকে তা সঠিক ভাবে কাজটি করছে কি না, তা জানা দরকার। সতর্কবার্তা অনেক সময় উচ্চ আবেগ ও ভুল পদক্ষেপকে প্রশ্রয় দেয়। তাই মানুষকে সুরক্ষা নিয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে না পৌঁছনো গেলে সমস্যা বেড়েই চলবে। ঝুঁকির অনিশ্চিয়তা নিয়েও ততটাই সৎ হওয়া প্রয়োজন। এ কথার স্পষ্ট উচ্চারণ দরকার যে, এত মানুষকে জায়গা দেওয়ার মতো স্বাস্থ্য পরিষেবাকেন্দ্র দেশে নেই। এমনকি যারা আক্রান্তদের পরীক্ষা করবে তাদের হাতেই এখনও পৌঁছয়নি দরকারি উপকরন। জনগণের সাবধানতার উপর নির্ভর করেছে রোগ সংক্রমণের গতি। মানুষ ঝুঁকি নিরূপণ এবং সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায়ে বিশেষ ভাবে পারদর্শি নয়। আচরণ বিজ্ঞান জানান দেয় যে, মানুষ ফলাফলের পূর্ববর্তী সচেতনতার আলোকে মূল বিচারগুলি সংশোধন করে পুনর্গঠন করে। তাই যে ফলাফল তাদের কাছে প্রবল ভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে না তাতে প্রতিক্রিয়াও কম। মৃত্যুর গল্প সে শুনছে। ভয়াবহতা অনুভব করছে। কিন্তু চারপাশে প্রত্যক্ষ করছে না। তাই বোধের জায়গায় হয়ত আসছে যে, শুরু হলে খতম। কিন্তু বিশ্বাসের জায়গায় আনতে পারছে না। নানাবিধ অসুখের মৃত্যুর হারের বিবরণের নিরিখেই করোনা তত মারাত্মক নয় বলে প্রচার আরও আত্মঘাতীর ভূমিকায় নিয়ে যাচ্ছে মানুষকে।

সঙ্কটকে কখনও আতঙ্ক দিয়ে মোকাবিলা করা যায় না। সচেতন সাহস ও স্বাস্থ্যপরিষেবাই শেষ কথা। সুরক্ষার দিকে মনোনিবেশ করা জরুরি। রোগ প্রসারের প্রচারের চেয়ে রোগের কারণ ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ দরকার। জনস্বাস্থ্যের কৌশলগুলি মান্যতা দেওয়ার ক্ষেত্রে বর্জনীয় বিষয়ের অনুশীলন ও চিকিৎসার প্রারম্ভ এই দুইয়ের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য প্রয়োজন। পীযূষ মান্ডি জানান, মানুষ এড়িয়ে যাচ্ছে গণমাচা। চায়ের দোকানে ভিড় কম। দুই একজন মুখে রুমাল বাঁধছে। এই বুঝি এসে গেল রোগ! এই আতঙ্কে ভুগছে সবাই। কিন্তু ঘরবন্দি কতদিন? এখন জীবনিশক্তি হল- নিরাপদ দূরত্বে থাকুন ও একা থাকুন।

শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন