সম্পাদকীয় ২

অপরিবর্তন

কোনও সভ্য সমাজে আদালতকে বলিয়া দিতে হইতেছে যে রাস্তা অচল করিয়া রাজনৈতিক জমায়েত চলিবে না, ইহাই যথেষ্ট লজ্জার কথা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৮ ০০:৩৭
Share:

বামফ্রন্টের যে সূর্য মধ্যগগনে ছিল, তাহা নিতান্তই অস্ত গিয়াছে। বিধানসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের আসনসংখ্যা ৬০ হইতে বাড়িয়া ২১১ হইয়াছে। বিজেপির রাজনৈতিক উত্থান হইয়াছে, সিঙ্গল স্ক্রিন প্রেক্ষাগৃহ বিলুপ্তপ্রায়, আইপিএল নামক মহোৎসবটিও এক দশক পার করিয়া ফেলিল। ২০০৩ সালে কলিকাতা ছাড়িয়া মঙ্গলগ্রহে পাড়ি দিয়াছিলেন, এমন কেহ আজ এই শহরে হঠাৎ উপস্থিত হইলে তাঁহার চারিপাশ বিলকুল অচেনা ঠেকিবে। যত ক্ষণ না শহর অচল করা কোনও মিছিল, অথবা রাস্তা জুড়িয়া কোনও সমাবেশ তাঁহার চোখে প়়ড়ে। তিনি বুঝিবেন, কলিকাতা যত পাল্টাইয়াছে, ততই অপরিবর্তিত থাকিয়া গিয়াছে। ২০০৩ সালে বিচারপতি অমিতাভ লালা রায় দিয়াছিলেন, সকাল ৮টা হইতে রাত্রি ৮টা অবধি শহরের রাস্তায় মিটিং-মিছিল নিষিদ্ধ। সে কালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু অশোভন মন্তব্যে সেই রায়ের বিরোধিতা করিয়াছিলেন। ২০১৮ সালে কলিকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দিল, কোনও বড় বা প্রধান রাস্তা সম্পূর্ণ আটকাইয়া সভা-সমাবেশ চলিবে না। এ কালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানাইয়া দিলেন, তাঁহাদের ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ যেমন হইত, তেমনই হইবে। ১৫ বছরে শহর বদলায় নাই, বলিয়া দিল আদালতের দুইটি রায়। কেন বদলায় নাই, বিমান বসু ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া শুনিলে সে বিষয়ে সংশয় থাকে না।

Advertisement

কোনও সভ্য সমাজে আদালতকে বলিয়া দিতে হইতেছে যে রাস্তা অচল করিয়া রাজনৈতিক জমায়েত চলিবে না, ইহাই যথেষ্ট লজ্জার কথা। দেড় দশক পরে আদালতকে কার্যত একই নির্দেশ ফের দিতে হয়, এই লজ্জা রাখিবার জায়গা মহানগরে নাই। সমস্যা হইল, যাঁহাদের লজ্জিত হওয়ার কথা, সেই রাজনীতিকরা কেবল কুযুক্তির বিস্তারেই সিদ্ধহস্ত। পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেমন বলিয়াছেন, তাঁহাদের ২১ জুলাই তারিখটি ‘‘আর পাঁচটি দিনের তুলনায় আলাদা।’’ দলের নিকট আলাদা কেন, সুবিদিত। কিন্তু রাজ্যের নিকট আলাদা কেন? অনুমান, তাঁহারা শাসক বলিয়া। পুলিশ তাঁহাদের আজ্ঞাবহ বলিয়া। আদালতের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মানিবার দায়িত্ব যে শাসক দলেরই সর্বাধিক, শাসকরা তাহা মনে রাখেন নাই। সে কালেও নহে, এ কালেও নহে।

কেন, সেই কারণ সন্ধান করিলে পশ্চিমবঙ্গের, এবং বৃহত্তর অর্থে ভারতের, রাজনীতির প্রধানতম অসুখের কথাটিই আসিবে। ভারত ভোটে লড়িতে শিখিয়াছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে সম্মান করিতে শিখে নাই। আদালত কোনও নির্দেশ দিলে তাহাকে পাশ কাটাইবার পথ খোঁজা নহে, তাহার সম্পূর্ণ পালনই যে কর্তব্য, এই কথাটি নেতারা শিখেন নাই। শহর নামক পরিসরটির উপর প্রথম এবং প্রধান অধিকার যে নাগরিকদের, এবং যতই রাজনৈতিক লাভ হউক না কেন কোনও মতেই সেই অধিকার লঙ্ঘন করা যায় না, নেতারা তাহা জানেন না, মানেনও না। তাঁহাদের নিকট সকলই যুদ্ধ। যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাঁহাদের ইচ্ছাপূরণের পথে বাধা হইয়া দাঁড়াইবেন, রাজনীতির চোখে তাঁহারা শত্রু বই আর কিছুই নহেন। তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করাই দস্তুর। সরাসরি যুদ্ধ, অথবা পরোক্ষে। ২০০৩-এর পশ্চিমবঙ্গ যেমন ছিল, আজও ঠিক তেমনই আছে। যুদ্ধ চলিতেছে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন