West Bengal

ভিত্তি ও ভবিষ্যৎ

সমৃদ্ধির বিচারে ইটালি এখন, জার্মানি ও ফ্রান্সের পরে, ইউরোপের তিন নম্বর দেশ। কিন্তু কোভিডের আক্রমণে তাহার অর্থনীতি বিপর্যস্ত, অগণিত নাগরিক কর্মচ্যুত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২০ ০০:০১
Share:

এক যুগ পূর্বে এই রাজ্যে ‘উন্নয়ন’-এর শপথ ঘোষিত হইয়াছিল: কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ। যুগ বদলাইয়াছে, রাজনীতির দুর্নিবার চক্রের আবর্তনে জমানা বদলাইয়াছে। উন্নয়নী স্লোগানও। কিন্তু উন্নয়নের ধারণাটি পরিত্যক্ত হইয়াছে, এমন কথা মনে করিবার কারণ নাই। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকরাও গত প্রায় এক দশকে বারংবার জানাইয়াছেন— তাঁহারা শিল্পবিরোধী নহেন; রাজ্যের বাস্তব পরিস্থিতিকে মনে রাখিয়া এবং কৃষিজীবী তথা গ্রামবাসীর স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখিয়া শিল্পের উন্নয়ন তাঁহাদেরও কাম্য। কৃষি ও শিল্পের সম্পর্ক এবং উন্নয়নের ধারণা লইয়া আলোচনা ও বিতর্ক বহুলপরিচিত। অর্থশাস্ত্রের পরিসরেও, আর্থিক নীতির ভুবনেও। সেই বিশ্লেষণ ও কর্মকাণ্ড হইতে সামগ্রিক ভাবে যে ধারণাটি সাব্যস্ত হইয়াছে তাহা মোটের উপর উপরোক্ত স্লোগানটির অনুসারী। অর্থাৎ, উন্নয়নের ভিত্তি হিসাবে কৃষির ভূমিকা অস্বীকার করা না হইলেও তাহার প্রধান চালিকা শক্তি সরবরাহ করিবে শিল্পায়নের ‘অগ্রমুখী’ প্রক্রিয়া, এই ধারণা কার্যত সর্বজনস্বীকৃত— ষোলো আনা না হইলেও পনেরো আনা।

Advertisement

অনেক প্রচলিত ধারণার মতোই, এই ধারণাটিতেও ধাক্কা দিয়াছে কোভিড-১৯ অতিমারি। শিল্পবাণিজ্যে বিপর্যয়ের বিপুল প্রভাব পড়িয়াছে কর্মসংস্থানে, বহু দেশে বহু কর্মী কাজ হারাইয়াছেন। কত দিনে অর্থনীতির মৃতদেহে জীবনসঞ্চার হইবে, কর্মপ্রার্থীরা কাজ পাইবেন, অনিশ্চিত। বিপরীত সমস্যাও দেখা দিয়াছে— কর্মীর অভাব। যে সব ক্ষেত্রে পরিযায়ী শ্রমিকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে ইহা ইতিমধ্যেই প্রকট, ভবিষ্যতে বাড়িবার আশঙ্কা। আজ হইতে সরকারি ও বেসরকারি কর্মস্থল পুনরায় চালু হইলেও ভিন্ রাজ্যের শ্রমিক-কর্মীদের সামান্য অংশই হয়তো প্রত্যাবর্তন করিবেন। এই সমস্যা কেবল শিল্প, নির্মাণ, ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রেই নহে, কৃষিতেও। ভারতের নানা অঞ্চলে, যেমন উত্তর-পশ্চিমের ‘সবুজ বিপ্লব’-এর বলয়ে বহু কৃষিশ্রমিক স্থানীয় নাগরিক নহেন, অন্য রাজ্য হইতে পরিযায়ী। তাঁহারা যাতায়াত করিতে না পারিলে ওই অঞ্চলের কৃষিকাজ ব্যাহত হইবেই। এই পরিস্থিতিতে কৃষিতে স্থানীয় বা নিকটবর্তী এলাকার কর্মীদের কাজে লাগাইবার উদ্যোগ হয়তো কার্যকর হইবে।

সমস্যাটি কেবল ভারতের নহে, অন্য নানা দেশেরও। যেমন ইটালি। গত শতাব্দীর প্রথম ভাগ অবধি দেশটিতে কৃষির গুরুত্ব ছিল বিরাট, বিশেষত কর্মসংস্থানের উৎস হিসাবে। তাহার পরে, বিশেষ করিয়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী কালে উন্নয়নের দৌড় জোরদার হয়। সমৃদ্ধির বিচারে ইটালি এখন, জার্মানি ও ফ্রান্সের পরে, ইউরোপের তিন নম্বর দেশ। কিন্তু কোভিডের আক্রমণে তাহার অর্থনীতি বিপর্যস্ত, অগণিত নাগরিক কর্মচ্যুত। অন্য দিকে, বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষিশ্রমিকের ঘোর অনটন, কারণ সেখানে কর্মীরা আসেন অন্য নানা দেশ হইতে, এমনকি অনেক ভারতীয় কর্মীও থাকেন সেই পরিযায়ীর দলে। এখন কৃষিজমির মালিকদের বাধ্য হইয়া স্থানীয় কর্মী খুঁজিতে হইতেছে, অন্য ক্ষেত্রে কাজ-হারানো কর্মীরাও কৃষি-কাজ করিতে আসিতেছেন। এই পরিবর্তন প্রায়শই সহজ নহে, কারণ কৃষির কাজে যে ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন হয়, তাহা এক দিনে অর্জন করা যায় না। কিন্তু ঠেকায় পড়িলে মানুষ নূতন দক্ষতা শিখিতে বাধ্য হয়। আরও বড় কথা, নূতন করিয়া ভাবিতেও বাধ্য হয়। ইটালির কৃষিমন্ত্রী বলিয়াছেন, অতিমারি আমাদের উন্নয়নের ধারণাটি লইয়া নূতন ভাবনায় বাধ্য করিতেছে, কৃষির ভূমিকা সম্পর্কেও নূতন করিয়া ভাবিতে হইতেছে। কথাটি গুরুত্বপূর্ণ। এই ভাবনা মন্থন করিয়া হয়তো কৃষি, শিল্প ও উন্নয়নের সামগ্রিক কাঠামোটির এক নূতন রূপরেখা তৈয়ারি হইবে। সেখানে কৃষি এবং শিল্প, উভয়েই একই সঙ্গে ভিত্তি ও ভবিষ্যৎ বলিয়া স্বীকৃত হইবে। এই পশ্চিমবঙ্গেও।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement