কাশ্মীরে বিশ্বাস ফিরবে কি

সব থেকে বিপজ্জনক প্রবণতা হল, সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জনমানসের ঘৃণা ও বিক্ষোভকে এক করে দেখা হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদী না হয়েও যে বিক্ষোভ দেখানো যায়, সেই সহজ কথাটাই আতঙ্কিত, সন্ত্রস্ত রাষ্ট্র মনে করতে চায় না।

Advertisement

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share:

কাশ্মীরের বিক্ষোভ ঠেকাতে কিছু দিন আগেও ভারত সরকার আলোচনার চেয়ে বন্দুকেই ভরসা রেখেছে বেশি। বুলেটের মুখে মানবিক মুখোশ পরাতে হাতে তুলেছে ছররা বন্দুক (পেলেট গান)। ফলে কাশ্মীরের অসংখ্য যুবকযুবতী চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। তাদের দেহে সিসার ছররার আলপনা। সব থেকে বিপজ্জনক প্রবণতা হল, সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জনমানসের ঘৃণা ও বিক্ষোভকে এক করে দেখা হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদী না হয়েও যে বিক্ষোভ দেখানো যায়, সেই সহজ কথাটাই আতঙ্কিত, সন্ত্রস্ত রাষ্ট্র মনে করতে চায় না।

Advertisement

আর বলপ্রয়োগ সত্ত্বেও পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণে থাকে না? এই সে দিন জম্মু-কাশ্মীর সফরে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলে এসেছেন তা শুনলে চমৎকার লাগে! রাজনাথ বলেছেন, ‘‘এখনও সব কিছু শুকিয়ে যায়নি। চার পাশে তাকালে দেখবেন, সবুজ গাছের চারা দেখা যাচ্ছে।’’ রাজনাথের দাবি, কা‌শ্মীরের পরিস্থিতি ক্রমশ স্বাভাবিক হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনায় বসার আগ্রহ প্রকাশ করে বলেছেন, পাঁচ বারের বদলে তিনি পঞ্চাশ বার কাশ্মীরে যেতে রাজি আছেন। তাঁর বক্তব্যে যেন এক মানবিক মুখের উঁকিঝুঁকি! গত দু’বছর ধরে কাশ্মীরে পাথর ছোড়ার ঘটনায় যারা নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে তাদের অনেকেই নাবালক। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য: ‘‘নিরাপত্তারক্ষীদের বলেছি, যাদের বয়স ১৮-র নীচে তাদের সঙ্গে যেন পোড়খাওয়া অপরাধীর মতো ব্যবহার করা না হয়।’’ মনে পড়ে, কিছু দিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কাশ্মীরি ভাইদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘গলে লাগ যা’। গত মাস তিনেক কাশ্মীর প্রশ্নে কিছুটা যেন নরম মনোভাব নিয়েছে কেন্দ্র।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সুমধুর ভাষ্যে কাশ্মীর উপত্যকার অবিশ্বাসের বরফ কি উষ্ণতার স্পর্শ পাচ্ছে? এখনও পর্যন্ত তা মনে হয় না। বরং উপত্যকার জনমানসে ‘মূল ভারত’-এর মনোভাব নিয়ে বরাবর যে সংশয় ছিল, এখনও তা-ই আছে। মূল সমস্যাটা হল, কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদকে বরাবর জুড়ে দেওয়া হয়েছে। জনমানসে এই ধারণা গেঁথে দেওয়া হয়েছে যে, যাঁরাই কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা বলবেন, গণভোটের কথা বলবেন, তাঁরাই দেশদ্রোহী, পাকিস্তানের দালাল, রাষ্ট্রদ্রোহী। অথচ, কাশ্মীরের ইতিহাস বলছে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজত্বে নিপীড়নের বিরুদ্ধে কাশ্মীরিরা সরব হয়েছেন। বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। ইতিহাস বলছে, তৎকালীন ডোগরা রাজাদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে ১৯৩১-এর ১৩ জুলাই কাশ্মীরের সোফিয়ান-এ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন মানুষ। রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। সেই বিক্ষোভে ডোগরা রাজপুত বাহিনী গুলি চালালে ২২ জনের মৃত্যু হয়। কাশ্মীরের বহু মানুষ মনে করেন, সে দিন থেকেই বস্তুত কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনের সূত্রপাত।

Advertisement

কাশ্মীর রাজ্যের শেষ মহারাজা হরি সিংহের বিরুদ্ধে যখন ‘কাশ্মীর ছাড়ো’ আন্দোলন তুঙ্গে, সেই ১৯৪৬ সালে আইনজীবী হিসেবে শ্রীনগর আদালতে আসেন নেহরু। হরি সিংহের শাসনভারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। ১৯৪৭-এর অগস্টের প্রথম সপ্তাহে শ্রীনগর সফরের সময় মহাত্মা গাঁধীও জম্মু-কাশ্মীরের শাসক হিসেবে সে প্রশ্ন তুলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘পিপল’স উইল, অ্যান্ড নট দ্য রুলার’স উইশ, ইজ ইম্পর্ট্যান্ট।’’

এখন ওই মন্তব্য কেউ করলে সে লহমায় পরিণত হবে দেশদ্রোহীতে। তাকে শুনতে হবে, ‘‘যখন ওরা মারে, তখন এই দরদ কোথায় ছিল? তোষণ হচ্ছে? পাকিস্তানে যা।’’ এ কথার ‘যুক্তি’টা সহজেই বোঝা যায়— ‘ওরা’ যখন মারে তখন তো ‘দেশ’-এর মানুষকে এক হয়েই লড়তে হবে! সীমান্তপারে শত্রু, সীমান্তের এ পারেও শত্রু। যে যুবকেরা পাথর ছোড়ে তারা নিশ্চয় সকলেই টাকা পায় জঙ্গিদের কাছ থেকে, যে যুবকদের আচমকা দেখা যাচ্ছে না তারা নিশ্চয়ই পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবিরে রয়েছে!

শুধু জানা যায় না, নামহীন, রহস্যময় গোরস্থানে কারা শুয়ে রয়েছে নিভৃতে, তাদের পরিচয় কী? হাজার হাজার মানুষ যে ‘নিখোঁজ’ হয়ে গেল, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে ‘সংঘর্ষ’-এ এত যুবকের যে মৃত্যু হল, তারা সকলেই সন্ত্রাসবাদী?

এই বাতাবরণের মধ্যে আলোচনা? কাশ্মীরের মানবাধিকার কর্মী, সমাজকর্মীদের একটা বড় অংশ বলছেন, এখনও উপত্যকায় ছররা বন্দুকের ব্যবহার চলছে। জনসুরক্ষা আইনের (পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট) নির্বিচার প্রয়োগ করে ব্যাপক ধরপাকড় চালানো হচ্ছে, মোবাইল পরিষেবা, ইন্টারনেট কথায় কথায় বন্ধ করা হচ্ছে। সেখানে কোন যুক্তিতে বলা যাবে যে, পরিস্থিতি এখন অনেক শান্ত? এর আগে কোনও বারই কাশ্মীরে শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। কাশ্মীরের সমাজকর্মীদের ধারণা, ইউপিএ-র মতো এনডিএ আমলেও একই পন্থা নেওয়া হচ্ছে। সেই ‘আ গলে লাগ যা’ বলে সময় কেনা।

সকলেই চাইবেন, উপত্যকাবাসীর উদ্দেশে নরেন্দ্র মোদী এবং রাজনাথ সিংহের বার্তা ফলপ্রসূ হোক। কিন্তু আগে রাজনাথদের সুনিশ্চিত করতে হবে, আলোচনা যেন আগ্নেয়গিরির শিখরে না হয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন