Ram Mandir

বিকল্প

হরেক প্রশ্নে এ হেন টানাপড়েন, এই দ্বিধাই কংগ্রেস-রাজনীতির চিরকালীন সত্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০২০ ০১:২৫
Share:

ছবি পিটিআই।

কেবলমাত্র প্রিয়ঙ্কা গাঁধীই নহেন, কংগ্রেসের বহু নেতাই সাম্প্রতিক অতীতে রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকে স্বাগত জানাইয়াছেন। কমল নাথ স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন, ১৯৮৫ সালে বাবরি মসজিদের তালা খুলিয়া দিয়াছিলেন স্বয়ং রাজীব গাঁধী। অস্যার্থ, মন্দির প্রতিষ্ঠায় কংগ্রেসের অবদানও ভুলিলে চলিবে না। ধর্মনিরপেক্ষ উদার ভারতের বুকে বিজেপি যে অমোঘ কুঠারাঘাতটি করিল, কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা সেই ‘কৃতিত্ব’-এর ভাগ লইতে এমন মরিয়া কেন, তাহা বুঝা যায়— রাজনীতি বড় বালাই। গত নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যা জমি মামলার রায় দিবার পরও কংগ্রেস তাহাকে স্বাগতই জানাইয়াছিল। প্রশ্ন হইল, ইহা ভিন্ন আর কোনও পথ কংগ্রেসের নিকট খোলা ছিল কি? রামমন্দির হউক বা কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলুপ্তি, বিজেপির রাজনীতি গণপরিসরে প্রশ্নগুলিকে এমন ভঙ্গিতে সাজাইয়া দিয়াছে যে, কংগ্রেসের সম্মুখে কার্যত দুইটি বিকল্প উপস্থিত— হয় বিজেপির সুরে সুর মিলাইয়া যাওয়া, অথবা মানিয়া লওয়া যে, তাহাদের অবস্থান দেশের সিংহভাগ মানুষের আবেগ-বিরোধী। কেন প্রিয়ঙ্কা গাঁধীদের রামমন্দিরের ভূমিপূজাকে স্বাগত জানাইয়া টুইট করিতে হয়, তাহা বুঝা সম্ভব।

Advertisement

বস্তুত, হরেক প্রশ্নে এ হেন টানাপড়েন, এই দ্বিধাই কংগ্রেস-রাজনীতির চিরকালীন সত্য। নরেন্দ্র মোদীর আমলে বা বাবরি মসজিদের দরজা খুলিয়া দেওয়ার মুহূর্তে নহে, পুরুষোত্তম দাস টন্ডন বা রাজেন্দ্র প্রসাদদের চাপের মুখেও নহে— তাহারও পূর্বে, বিংশ শতকের গোড়া হইতেই, কংগ্রেসকে হিন্দু-মুসলমান সৌভ্রাতৃত্ব (যাহা পরবর্তী কালে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি হইয়া উঠে) বনাম হিন্দুত্ববাদের ভারসাম্য রক্ষা করিয়া চলিতে হইয়াছে। সেই দীর্ঘ ইতিহাসের উজ্জ্বলতম পর্বটি অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর শাসনকাল, যখন সত্যই সাম্প্রদায়িকতাকে পশ্চাতে ফেলিয়া উন্নয়নকেন্দ্রিক পরিচিতি নির্মাণের চেষ্টা হইয়াছিল। তাহা ভারতের উদারনৈতিক রাষ্ট্রভাবনার স্বর্ণযুগ। এক্ষণে প্রশ্ন উঠিতে পারে, দেশ যে ভাবে পাল্টাইয়া গিয়াছে; জাতীয়তাবাদ হইতে ধর্ম, প্রতিটি প্রশ্নেই সাধারণ মানুষ যে মতামত পোষণ করিতেছেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে উদারবাদী ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি কি আজ আর প্রাসঙ্গিক? সেই রাজনীতি দার্শনিক তর্কের বিষয় হইতে পারে, নাগরিক সমাজ ‘তে হি নো দিবসা গতাঃ’ বলিয়া দীর্ঘশ্বাসও ফেলিতে পারে— কিন্তু, যে দলকে ভোটের রাজনীতি করিতে হয়, তাহার পক্ষে কি সেই ধ্রুপদী উদারনীতিকে ধরিয়া বাঁচা সম্ভব?

সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যদি জাতীয়তাবাদের আফিমে বুঁদ হইয়া থাকে, হিন্দুত্বের মৌতাত পোহায়, তবে কংগ্রেসের পক্ষেও সেই বহতা নদীতে হাত ধোয়া ভিন্ন উপায় থাকে না— যদি না তাঁহারা নিজেদের রাজনৈতিক কল্পনাটিকে ব্যবহার করিতে পারেন। এখন তাঁহারা বিজেপির লিখিত চিত্রনাট্যে নিজেদের ঠাঁই খুঁজিয়া চলিতেছেন। বিজেপি যাহাকে জাতীয়তাবাদ বলে, সঙ্ঘ পরিবার যাহাকে হিন্দুর আত্মপরিচিতি বলে, কংগ্রেস তাহাতেই নিজের দখল কায়েম করিতে চাহিতেছে। অথচ, কংগ্রেসের ইতিহাসই সাক্ষ্য দিবে যে সঙ্কীর্ণ, একদেশদর্শী সংজ্ঞার বিরুদ্ধে বৃহত্তর, সর্বজনীন সংজ্ঞা নির্মাণ করা সম্ভব, সে সংজ্ঞায় মানুষকে বাঁধাও সম্ভব। গাঁধী যে রামরাজ্যের কথা বলিতেন, তাহাও হিন্দু ধর্ম— কিন্তু তাহার সহিত আর্য সমাজ বা সঙ্ঘের হিন্দুত্বের দূরত্ব আলোকবর্ষের। দেশভাগ-উত্তর, প্রাদেশিক খণ্ড জাতীয়তাবাদী দাবি-মুখরিত দেশে নেহরু বলিয়াছিলেন উন্নয়নকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের কথা— ভারতীয়দের পরিচিতি নির্মিত হইবে সঙ্ঘবদ্ধ উন্নয়নপ্রচেষ্টার সুরেই। রাহুল গাঁধীর কথায় মাঝেমধ্যেই এই বিকল্প আখ্যান নির্মাণের সুরটি শুনা যায়, স্বীকার করিতে হইবে। সেই পথে চলিবার সাধ্য দলের আছে কি না, তাহাই প্রশ্ন।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন