অপরাধী থাকে আয়নায়
The Lives of Animals

নিজের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকলে নৃশংসতাকে আমরা উপভোগ করি

মাথা কেটে নেওয়ার পর আরশোলা কত ক্ষণ বাঁচে? উত্তর: নয় দিন (কথাটা বিশ্বাস করে নিন, যাচাই করতে যাবেন না)।’

Advertisement

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share:

ছবি: সংগৃহীত

“সব অধিকারের চেয়ে বড় হল জীবনের অধিকার। বেঁচে থাকার অধিকার। আইনের চোখে গৃহপালিত প্রাণীদের জীবনের অধিকার স্বীকৃতি পাবে, তেমন কোনও সম্ভাবনা আমি দেখতে পাই না।”

Advertisement

জে এম কোয়েটজ়ি, দ্য লাইভস অব অ্যানিম্যালস

মাথা কেটে নেওয়ার পর আরশোলা কত ক্ষণ বাঁচে? উত্তর: নয় দিন (কথাটা বিশ্বাস করে নিন, যাচাই করতে যাবেন না)।’ এই প্রশ্নোত্তর হুবহু এই ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল একটি বিজ্ঞান পত্রিকার পাতায়। এই তথ্য পেয়ে পাছে অনেকেই আরশোলার মতো কুৎসিত প্রাণীর মুণ্ডচ্ছেদের পরীক্ষা করে দেখতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, তাই ওই নিষেধাজ্ঞা। এতে প্রমাণিত হয়, আমরা মজ্জাগত নিষ্ঠুরতাকে সত্তার অঙ্গ হিসেবে বহন করি এবং সে কথা আমরাই সবচেয়ে ভাল করে জানি। পর পর দু’টি ঘটনায় নিষ্ঠুরতা এবং অমানবিকতা নিয়ে তোলপাড় হয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে বহু দিন আগে পড়া কথাটা মনে পড়ল। এই শোরগোলের কেন্দ্রে একটি হাতি এবং কিছু মৃতদেহ। কিন্তু এই আলোড়ন কতটা যথার্থ, প্রশ্নটা সেখানেই।

Advertisement

কেরলে হাতিটি যে ভাবে মারা গিয়েছিল, সেই সুপরিকল্পিত নৃশংসতা একমাত্র মানুষের পক্ষেই সম্ভব। আর সত্যি কথাটা হল, পশুপাখির প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতা নতুন নয়। আমাদের চিকেন কাবাবে, হালাল মাংসে, ফার বা মিঙ্ক কোট ও আরও লাখ লাখ প্রাণিজ পণ্যে, মোরগ লড়াই, জাল্লিকাট্টু, টোপ দিয়ে বাঘ শিকার আর অন্য হাজার উল্লাসে লেখা আছে নিষ্ঠুরতার ধারাবাহিক ইতিহাস।

প্রশ্নটা আসলে নিপীড়ন নিয়ে। মানে, প্রাণীকে কষ্ট দেওয়া নিয়ে। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রবিশিষ্ট সমস্ত প্রাণীরই কম-বেশি যন্ত্রণার অনুভূতি আছে। আর উন্নততর প্রাণী হিসেবে একমাত্র মানুষের অন্যান্য প্রাণীর যন্ত্রণাকে অনুভব করার ক্ষমতা ও দায়িত্ব আছে। যাকে সহমর্মিতা বা এমপ্যাথি বলে। এই ভাবে ভাবলে, নিষ্ঠুরতাও একটি বৈশিষ্ট্য যা মানুষকে পশুর থেকে আলাদা করে। হরিণ মেরে খাওয়ার জন্য বাঘকে যেমন নিষ্ঠুর বলা যায় না, তেমনই খাদ্য, আত্মরক্ষা বা সম্পদরক্ষার প্রয়োজনে বাঘ-হাতি-শুয়োরদের মারলেই মানুষকেও নিষ্ঠুর বলা যায় না। কিন্তু উন্নততর প্রাণী হিসেবে কষ্ট দেওয়ার উপায়ও মানুষের হাতেই আছে। যার প্রমাণ হল বারুদ ঠাসা আনারস। এই উপায়টিও নতুন নয়। বুনো শুয়োরের হাত থেকে ফসল বাঁচাতে পদ্ধতিটা বহু দিন ধরেই ব্যবহার হয়। শুয়োর মরে গেলে তার মাংস খাওয়া হয়, তাই সেটা খবর হয় না।

এই বছরে হাতি, গত বছরের ষোলোটা কুকুরছানা, তার আগে অবনী বাঘিনি— প্রত্যেকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাতেই আমরা কষ্ট পাই, দোষীর শাস্তি চাই, কিন্তু পশুপাখিদের প্রতি রোজকার ধারাবাহিক নিষ্ঠুরতায় চোখ বুজে থাকি। এখানেই আমাদের দ্বিচারিতা। সাইকেলের হ্যান্ডেলে রোজ হেঁটমুণ্ড হয়ে ঝুলে থাকে মুরগি, চোখের সামনেই উদাসীন ভাবে তাদের ডানা ছেঁড়া, গলা কাটা, পা ভাঙা দেখি। শুয়োরের মৃত্যু-আর্তনাদ শুনি। দুর্গা পুজোর আনন্দের মধ্যে ছিটকে ওঠা ছাগলছানার অন্তিম আর্তনাদেও সে ভাবে বিচলিত হই না। তা ছাড়া কুকুরের লেজে পটকা, বিড়ালের গায়ে গরম জল, ইঁদুরকে কলে থেঁতলে দেওয়া— সবই জীবজন্তুদের অকারণে যন্ত্রণা দিতে অসীম উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রয়োগের পরিচয়। প্রতি দিনের এই সব নিষ্ঠুরতাকে জীবনের অঙ্গ বলে মেনে নিলে একটি হাতিকে নিয়ে অশ্রু বিসর্জনের আর তত মূল্য থাকে কি?

জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা নিয়ে কথা বলতে গেলেই শুনতে হয়— গাছপালারও তো প্রাণ আছে, তা হলে তো আনাজও কেটে খাওয়া চলে না। কিন্তু উদ্ভিদের চেয়ে প্রাণিদেহের অঙ্গ-তন্ত্র-কোষ-কলার গঠন, জন্ম-মৃত্যু-বেড়ে ওঠা-সাড়া দেওয়া সবই যে অনেকটা আলাদা— সে কথা স্কুলের বিজ্ঞান ক্লাসে সবাই জেনেছেন। চোখেও দেখেছেন যে গাছের ডাল কেটে নেওয়া আর ছাগলের পা কেটে নেওয়া একই রকম ঘটনা নয়। নিষ্ঠুরতার অজুহাত খাড়া করতেই এই সব অবান্তর কথার অবতারণা। খাবারের জন্য পশু সংহার করতেই হয়। কিন্তু প্রযুক্তিকে আয়ত্তে আনার পর মানুষের হাতে তো যন্ত্রণাবিহীন পদ্ধতিতে হত্যা করার উপায় আছে। তা হলে সেটা কাজে না লাগিয়ে এখনও আমরা কেন আদিম ও বর্বর পদ্ধতিতেই মুরগি মারি? উত্তর একটাই। নিষ্ঠুরতাকে আমরা স্বাভাবিক মনে করি এবং এই ক্ষেত্রে শিক্ষিত অশিক্ষিত ধনী দরিদ্র কোনও তফাত নেই। প্রতি দিনের এই নিরবচ্ছিন্ন নিষ্ঠুরতায় চুপ করে থেকে একটি ঘটনায় হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে তাই আসলে কোনও লাভ নেই।

ঠিক তেমনই কয়েকটি দাবিদারহীন বিকৃত মৃতদেহ আঁকশি দিয়ে টেনে আনার ছবি দেখে আমরা হঠাৎ ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়লাম। যে কারণে সরকারকে তড়িঘড়ি এই বিষয়ে বিল আনার কথা বলতে হল। এই উদ্বেগের কারণ করোনা-আতঙ্কে শবদেহ পাচারের সংশয় বা দৃশ্য দূষণ নয় (সেটা হলে ভিডিয়োটি ‘ভাইরাল’ হত না)! মাননীয় রাজ্যপাল সমেত আমাদের সকলের উত্তেজনার কেন্দ্র হল মৃতদেহের অমর্যাদা! কিন্তু প্রতি দিন জীবিত মানুষের অবমাননা, অপরিসীম যন্ত্রণা দেখে নির্বিকার থাকাই তো আমাদের অভ্যাস। সেখানে কয়েকটি পরিচয়হীন, বিকৃতপ্রায় শবদেহের মর্যাদা নিয়ে এতটা বিচলিত হওয়া কি আমাদের শোভা পায়?

এক কথায় এর উত্তর হয় না। কাজটা খুবই খারাপ হয়েছে সন্দেহ নেই; মৃতদেহের সম্মান রক্ষা অবশ্যকর্তব্য এবং সৎকারের রীতিনীতিও নিশ্চয়ই পালনীয়। কিন্তু এটা তো মানেন যে শবদেহের চেয়ে জীবিত মানুষের সুষ্ঠু জীবনের দাবি বেশি। তা আমাদের চার পাশে জীবিত মানুষরা ঠিক কেমন আছেন? মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, যে কোনও প্রাণীকে আঘাত বা হত্যা করলে মানুষের অবচেতনে বিভিন্ন মাত্রার অপরাধবোধ জন্ম নেয়। মশা-মাছির মতো ছোট্ট প্রাণীকে মারলে এই অনুভূতি সবচেয়ে কম, আর মানুষের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু চার দিকে সারা ক্ষণই দেখি, কারণে-অকারণে মানুষ মানুষকে যন্ত্রণা দিচ্ছে, মেরে ফেলছে। তাই মনে হয় ওটুকু অপরাধবোধ বুঝি জয় করা হয়ে গিয়েছে। বেঁচে থাকার অঙ্গ হিসেবে রোজ আমরা নৃশংসতার পাঠ নিই। চলচ্চিত্রের নায়করা পুলিশ সেজে হেফাজতে থাকা সন্দেহভাজনকে নির্মম প্রহার করেন, প্রতিশোধ নিতে একের পর এক খুন করেন। আমরা উপভোগ করি। যে সময়ে মান্নারকাডে হাতিটা মারা যাচ্ছে সেই সময়েই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ আর্তনাদ করছেন, ‘আই কান্ট ব্রিদ’। আর আজ হাতিটির শোকে যাঁরা ভারাক্রান্ত, বিভিন্ন সময়ে অপরাধীদের প্রতি তাঁরাই তো শাস্তির নানা নিদান দেন (হাতে পেলে করেও দেখান)। পুলিশ ও সেনাবাহিনী সন্দেহের বশে বা ‘সবক’ শেখাতে বৈধ উপায়েই নাগরিকের প্রতি কী ব্যবহার করেন তাও অজানা নয়। ক’দিন আগেই তুতিকোরিনে পুলিশের হেফাজতে নৃশংস অত্যাচারে একসঙ্গে প্রাণ হারালেন বাবা-ছেলে। অপরাধ— তাঁরা নাকি লকডাউন অমান্য করেছিলেন। অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য লকডাউন নয়, লকডাউনের জন্যই বেঁচে থাকা!

সারা দেশে এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে, আমরাও চুপচাপ দেখেই চলেছি। অনেকেই জানি না যে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অভিযুক্তের গায়ে হাত তোলার অধিকার পুলিশের নেই। নিষ্ঠুরতা দিনে দিনে আমাদের কাছে যে রকম স্বাভাবিক, অপরিহার্য, বৈধ, বীরত্বসূচক এমনকি উপভোগ্যও হয়ে উঠছে, তার পরে বোধ হয় এই নিয়ে আর কথা চলে না।

তবুও কথা চলবে। কথা চালিয়ে যাওয়া আমাদের কর্তব্য। যাবতীয় নিষ্ঠুরতাকে আমরা পাশবালিশ বানিয়ে ফেলেছি বলেই আজও তাই নিয়ে কথা বলা যাবে না, হতে পারে না। বরং যন্ত্রণাকাতর হাতিটি বা তুতিকোরিনের পরিবারটি থেকে শুরু করে এই সর্বব্যাপী নৃশংসতাকে আমাদের চিনতে হবে। তার বিরুদ্ধে সরব হতে হবে। কাজটা কঠিন। কারণ নিষ্ঠুরতাকে আমরা নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করতে পারি না। নিষ্ঠুরতা নিয়ে তখনই ভাবি, যখন সেটা আমার পোষ্য, পরিবার, দেশ, ধর্ম বা দলের মানুষের সঙ্গে ঘটে। অন্য সময় যে কোনও নিষ্ঠুরতাকে উপেক্ষা করি। এমনকি সমর্থনও করে ফেলি। ছর্‌রা বুলেটের দাগ ভরা কিশোরীর মুখ বা জিপে বাঁধা যুবকের ছবি দেখে ‘লাইক’ দিয়ে ফেলি! আর এই কঠিন সময়ে যাঁরা শবদেহের অমর্যাদা নিয়ে ব্যথিত, তাঁদেরই কেউ কেউ দু’দিন আগে কাঁধে শিশু নিয়ে হাঁটা শ্রমিকের ছবিকে ‘ফোটোশপ’ বলেছেন।

সমস্যাটা এখানেই। বিচ্ছিন্ন দু’-একটি ঘটনায় উত্তেজিত হয়ে ‘মানুষ’-কে দোষারোপ করার আগে নিজের দিকে তাকানো চাই। নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতার ফাঁদ থেকে বার হতে নিজেদের সার্বিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। সেটা হয় না বলেই বিচলিত হওয়ার মতো ঘটনা বার বার ঘটে চলে। তার কুফল আমাদেরও নানা সময় ভোগ করতে হয়। নিষ্ঠুরতা-বিরোধী শিক্ষা যদি আমাদের মধ্যে কাজ করতে শুরু করে, তবে তার প্রতিফলন সমাজে দেখা যাবে। তার সুফল পাবে আমাদের সন্তানেরা।

ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, কলকাতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন