হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথ হাঁটছি আমরা পাশাপাশি। তবু ভারসাম্যে পৌঁছল না দুই অস্তিত্ব। নারীর জন্য আজও দুই চরম পরস্পর বিরোধী দৃষ্টিকোণ এ সভ্যতার। সমাজের এক পিঠে তাঁকে মা অথবা বোন অথবা মেয়ে হিসেবে দেখা হয়। সমাজের অন্য পিঠে তাঁর শ্লীলতাহানি হয়, নির্যাতন হয়, ধর্ষণ হয়।
নারীকে অর্ধেক আকাশ নামে ডাকি, অনেকেই ডাকি। কিন্তু ‘আকাশ’ শব্দের ব্যাপ্তি বুঝি না ঠিক মতো। আকাশের যে অপার মুক্তি, অসীম অস্তিত্ব, নারীর মাঝে তা খোঁজার চেষ্টা হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। বিচ্ছিন্ন ভাবেই হোক বা সংগঠিত ভাবে, নারীর অসামান্য অর্জনের যে সব কাহিনী উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পৃথিবীর আকাশে, সে সবই অকুণ্ঠ প্রশংসা পায়। কল্পনা চাওলা থেকে সুনীতা উইলিয়ামস, সাইনা-সানিয়া থেকে সিন্ধু-দীপা— মুকুটের মণি হয়ে ওঠেন তাঁরা। কিন্তু এত সব সত্ত্বেও ঘরে ঘরে বাধা পায় নারীর উড়ানের আরও হাজার হাজার চেষ্টা। এ কথা মানতে হবে যে নগর-জীবনের পরিসরে আজ নারীর স্বরাজ অনেক বেশি, নারীর অস্তিত্ব অনেক সচ্ছন্দ। কিন্তু নগর সভ্যতার বাইরে যে বিশাল বিস্তার জুড়ে গ্রামীণ জনজীবনের অবস্থিতি, সে বিস্তার পুরুষতন্ত্রের সবক’টা অনাকাঙ্ক্ষিত বেষ্টনীকে এখনও ধরাশায়ী করে দিতে পারেনি। তাই নারী দিবস পালিত হয়, আসে-যায়, কিন্তু নারী-পুরুষের অস্তিত্বে ভারসাম্য অধরাই থেকে যায়। আজও কন্যাভ্রূণ হত্যা হয়, আজও সদ্যোজাত কন্যার মুখে নুন ঢেলে দেওয়া হয়, আজও পণের দাবিতে জুলুম হয়, আজও কন্যাসন্তান জন্মানোর খবরে পরিবারের মুখ ভার হয়।
সমাজমানসে আসলে পিতৃতন্ত্রের গভীর ছায়াপাত এখনও। স্থানে স্থানে সভ্যতার শিকড়টাকে পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্রের মাটি আজও আঁকড়ে রয়েছে খুব শক্ত করে। তাই নারী বৃহদংশের কাছেই আজও হয় আগলে রাখার সম্পদ, না হয় যথেচ্ছাচারের উপকরণ। নারীর সম্মানের প্রশ্ন উঠলেই তাঁকে মা-বোন-মেয়ের চোখে দেখতে চায় এ সমাজমানস। আর পিতৃতন্ত্রের বেষ্টনী ঘা খেলেই উজাগর হয় যথেচ্ছাচারের মানসিকতা। এই দুই দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই মুক্তি দরকার। নারীর অস্তিত্বকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নারীকে কোনও বিশেষ চরিত্র হিসেবে দেখতে হয় না। নারী তাঁর সব রকমের নিজস্বতা এবং বৈশিষ্টের সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ, স্বতন্ত্র ও মৌলিক অস্তিত্ব— এইটুকু ভাবতে শিখলেই যথেষ্ট।
সেই পূর্ণাঙ্গ, স্বতন্ত্র এবং মৌলিক অস্তিত্বের জন্য নিবেদিত যে তারিখটা, সেই তারিখে পাঠকদের জন্য আনন্দবাজার ডিজিটালের বিশেষ নিবেদন ‘অর্ধেক আকাশ’। মেয়েদের লড়াই, মেয়েদের অর্জন, মেয়েদের উত্থান মেয়েদের সুখ-দুঃখ, মেয়েদের বারোমাস্যা— নারীর জীবনের নানান রঙে আমাদের এই ‘অর্ধেক আকাশ’ উজ্জ্বল এখন। এ ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে পড়ুক আকাশ জুড়ে, ছাপিয়ে যাক দিগন্তরেখা, নারী দিবসে এমনই হোক অঙ্গীকার।