আওয়ামী লীগের পিছনে বিপুল সমর্থন, নির্বাচনী ফলাফলে স্পষ্ট উন্নয়নই তুরুপের তাস

এর আগেই অবশ্য আওয়ামী লীগের কয়েক জন সমর্থক এই পূর্ববাণী উচ্চারণ করেননি। বাংলাদেশের প্রাক্তন উপবিদেশমন্ত্রী আবুল হাশেম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘‘আওয়ামী লীগই সম্ভবত জিতবে, তবে কঠিন সংগ্রামের পর।’’

Advertisement

শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

জনাদেশ: অশান্তি সংঘর্ষ উপেক্ষা করে ভোট দেওয়ার লাইনে অপেক্ষা করছেন ভোটাররা, ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮। এএফপি

গত বছর অক্টোবর মাসের শেষে, নির্বাচনের ঠিক দু’মাস আগে কথা হচ্ছিল বাংলাদেশের অগ্রণী বুদ্ধিজীবী ও লেখক মুনতাসির মামুনের সঙ্গে। এই মতামত বিনিময়ের পর্বে উঠে এসেছিল নির্বাচনের প্রসঙ্গটি। আমার অবধারিত প্রশ্ন ছিল, নির্বাচনের ফলাফল কী হবে? উত্তরে, আওয়ামী লীগের ঘোষিত সমর্থক মুনতাসির মামুন নিশ্চয়তার সুরে বলেছিলেন, ‘‘আওয়ামী লীগই জয়ী হবে বিরাট ব্যবধানে।’’ তার মানে কি দীর্ঘকালীন প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা এবং শেখ হাসিনার তথাকথিত ‘কর্তৃত্ববাদী’ ভাবমূর্তি কোনও প্রভাবই ফেলবে না ভোটপ্রদানের সময়? ‘‘কোনও প্রভাব ফেলবে না’’ উত্তরে বলেছিলেন মুনতাসির মামুন।

Advertisement

এর আগেই অবশ্য আওয়ামী লীগের কয়েক জন সমর্থক এই পূর্ববাণী উচ্চারণ করেননি। বাংলাদেশের প্রাক্তন উপবিদেশমন্ত্রী আবুল হাশেম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘‘আওয়ামী লীগই সম্ভবত জিতবে, তবে কঠিন সংগ্রামের পর।’’ শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামানও ওই মন্তব্যের প্রতিধ্বনি করেছিলেন এবং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বামপন্থী সাংসদ চাঁচাছোলা ভাষায় ইংরেজিতে জানিয়েছিলেন, ‘‘দ্য স্টেকস আর সো হাই দ্যাট দ্য আওয়ামী লীগ ক্যান নট অ্যাফোর্ড আ ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন।’’

ফল প্রকাশের পর দেখা গেল, আওয়ামী লীগ সত্যিই বিরাট ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেছে। তার কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে অভ্রান্ত মুনতাসির মামুন দু’মাস আগেই বলেছিলেন, ‘‘দেখুন, আসলে আমাদের আর্থ-সামাজিক পরিবেশটাই পাল্টিয়ে দিয়েছে বর্তমান সরকার। একটির পর একটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচির সফল রূপায়ণ করে শাসক দল বাংলাদেশকে উন্নীত করেছে উন্নয়নশীল দেশের স্তরে এবং ভোটদাতারা উন্নয়নের এই সার্বিক উদ্যোগকে বিপুল সমর্থন জ্ঞাপন করবে। কয়েকটি সুনির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত পেশ করা যাক।’’ এই বলে বক্তা যে তালিকাটি পরিবেশন করেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। গুরুত্বপূর্ণ তালিকাটির উপর চোখ রাখা যাক।

Advertisement

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার সাত শতাংশের সীমা অতিক্রম করেছে, যার আর্থিক মূল্য ১,৯৭৫,৮১৭ কোটি টাকা। হতদরিদ্রের সংখ্যা লক্ষণীয় হারে হ্রাস পেয়েছে। ২০০৫ সালে যে অঙ্ক ছিল ৪১ শতাংশ, তা নেমে দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ১৬,৩৫০ মেগাওয়াট এবং বিদ্যুৎজালের এই প্রসারের ফলে ৮৩ শতাংশ গৃহেই বিদ্যুৎ পৌঁছে গিয়েছে। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের অঙ্ক হল তিন লক্ষ কোটি ডলার— চিন ও ভারত, সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়াও অকাতরে বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশে। দেশজুড়ে একশোটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলি জোর দিচ্ছে রফতানি বৃদ্ধির ওপর। গত বছরেই সর্বমোট রফতানির আর্থিক মূল্য দাঁড়িয়েছিল ৩৪.৮৫ লক্ষ কোটি টাকা।

ডিজিটাল বিশ্বেও, যাকে বলে, নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে ইতিমধ্যে। এই মুহূর্তে আট কোটি নাগরিক ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তেরো কোটি সিমকার্ড বাজারে চালু। উন্নয়নের এই পর্বে দেশে গড়ে উঠেছে এক সক্রিয় ও সংহত মধ্যবিত্ত শ্রেণি। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সেই পূর্বপরিচয়— কতিপয় ধনী এবং অগুনতি দরিদ্র— আর সত্য নয়। বাংলাদেশকে এখন আর ‘বটমলেস বাস্কেট’ বলা যাবে না, হেনরি কিসিংগার-এর উচিত তাঁর এই মন্তব্যটি প্রকাশ্যে প্রত্যাহার করে নেওয়া। এই মধ্যবিত্ত সমাজের নাগরিকেরা অগ্রপদক্ষেপ করতে উন্মুখ, এঁরা ‘অন্ত্রেপ্রেনিয়রিয়াল’ বা স্ব-উদ্যোগী।

এই তালিকাটি পেশ করার পর মামুন আরও জানিয়েছিলেন, ‘‘নিখাদ সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্যে আসন্ন চমকপ্রদ বিজয়ের কারণটি প্রতিষ্ঠা করলাম। এ সব ছাড়াও আরও একটি কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের অন্তর্গত যারা এ বার প্রথম ভোট দেবে, তাদের সংখ্যা এক কোটি বাষট্টি লক্ষ এবং এর অধিকাংশই ধর্মের নিগড়কে ছিন্ন করে ঢালাও ভোট দেবে শাসক দলকে, কেননা এরা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের উপাসক।’’

মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে তীব্র বিতর্ক আর ভাবাবেগও এই নির্বাচনে সহ-নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করেছে। এক দিকে নাগরিকেরা বিএনপি-র সঙ্গে জামাত-ই-ইসলামির নিবিড় মাখামাখি সুনজরে দেখেননি। অন্য দিকে, এ বারের ফলাফলই প্রমাণ করে যে বেশ কয়েক জন জামাতিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা এবং তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পক্ষে ছিল দেশের জনসাধারণ। সত্যি বলতে, বিরোধীদের ঐক্যজোটের অন্তর্ভুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি ও তাদের নেতারা, যেমন কামাল হোসেন, বিএনপি-জামাত সখ্যের বিরোধী ছিলেন।

বাংলাদেশের নির্বাচন বিশারদ এবং মুক্তিযোদ্ধা শামসুল আরেফিন এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘এ বারের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছিল। জানেন, ১৯৭১-এর পর চার দশক অতিক্রান্ত, তা সত্ত্বেও এই সে দিন পর্যন্ত অনেক বাংলাদেশি ঘুম থেকে উঠে নিজেদের প্রশ্ন করতেন, তাঁরা প্রথমে বাঙালি না মুসলমান। বঙ্গবন্ধু রমনা ময়দানে প্রদত্ত তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে দ্বিধাহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি প্রথমে বাঙালি, তার পর মুসলমান। এই নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে যে একদা দ্বিধাযুক্ত অনেকেই মুজিবের পথের অনুসারী। অন্য ভাবে বললে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্মৃতি নির্বাচকদের প্রভাবিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত উত্তরসূরি হিসেবে তাঁরা শাসক দলকেই বেছে নিয়েছিলেন।’’

এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, নির্বাচনের পর্বে বেশ কয়েকটি ঘোর অপ্রিয় ঘটনা ঘটেছিল। প্রাণহানি থেকে শুরু করে রিগিং, জালভোট প্রদান, ধর্ষণ অনেক কিছুই ঘটেছে। এই বিচ্যুতিগুলিকেই মূলধন করে বিরোধী ঐক্যজোট নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং নিরপেক্ষ, অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন দাবি করেছে। ঐক্যজোটের প্রধান কামাল হোসেন নির্বাচনটিকে ‘ফার্স’ এবং বিএনপি-র মুখ্যসচিব সিরজা ফকরুল ইসলাম আলমগীর ‘প্রহসন’ বলেছেন। বিরোধী জোটের সাত জন জয়ী প্রার্থী শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানও বয়কট করেছেন।

নির্বাচন কমিশন বিরোধী জোটের দাবি সমূলে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বলেছে যে বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও নির্বাচনের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হননি। তাঁরা সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে ‘সুষ্ঠু ও অবাধ’ বলেই অভিহিত করেছেন। তবে এখানে এক নিঃশ্বাসে বলা প্রয়োজন যে, বিচ্যুতিগুলি না ঘটলেও কিন্তু শাসকগোষ্ঠীই জয়ী হত, বিস্তর ব্যবধানেই হত। জনমতের মুখ্য দিশাই ছিল শাসক দলকে নিরঙ্কুশ সমর্থন জ্ঞাপন— কারচুপির সাহায্যে এই বিপুল সমর্থন অর্জন করা হয়নি।

তবে বিভিন্ন মহলে একটি প্রশ্ন উচ্চারিত হচ্ছে। তা হল, এই ঢালাও বিজয়ের পর শেখ হাসিনা কি আরও আক্রমণাত্মক এবং কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠবেন? হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের পরিচালক মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায় এই আশঙ্কাই প্রকাশ করেছেন। তবে সংশ্লিষ্ট অন্য প্রশ্নটিও এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। প্রশ্নটি হল, এক জন ‘আক্রমণাত্মক’, ‘কর্তৃত্ববাদী’ এমনকী স্বৈরাচারী নেত্রী কি কখনও রাজনীতির প্রাঙ্গণে এ রকম সর্বাত্মক বিজয় অর্জন করতে পারতেন? এই প্রশ্নটির সম্ভাব্য উত্তর হল, না।

অতঃ কিম্? নবনির্বাচিত সরকার কয়েকটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেবে। সেগুলি হল, ১) দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত খালেদা জ়িয়ার পুত্র তারেক রহমানের প্রত্যর্পণ সুনিশ্চিত করা, ২) তিস্তার জলবণ্টন কার্যকর করা, ৩) মুক্তিযুদ্ধের আদ্যন্ত বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের কঠোর শাস্তিপ্রদান এবং ৪) শিল্পায়ন ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা। এ সবই শেখ হাসিনাকে করতে হবে, বিরোধীহীন জমানায়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত ইনস্টিটিউট অব ফরেন পলিসি স্টাডিজ়-এর সিনিয়র ফেলো

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন