দেশের বাস্তব ছবিটি বুলেট ট্রেনের বিপরীত

সুষ্ঠু চিকিৎসা নেই, শরীরে আতর ছড়িয়ে লাভ কী

সে দিন ছিল নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিন়। দোকানদার বললেন, গুজরাতে বুলেট ট্রেন হচ্ছে? লোক ঠকানোর জায়গা পায়নি বিজেপি! আরে মশাই যথেষ্ট রেললাইন নেই। রোজ দুর্ঘটনা হচ্ছে। রেলমন্ত্রীকেই নাকি সে জন্য বদলে দিতে হল।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৬:১০
Share:

রাজধানী দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ককে বলা হয় ‘মিনি কলকাতা।’ প্রতি রবিবার সকালে আমি বাজারে যাই। মাছের বাজার থেকে দশকর্মা ভাণ্ডার, মুদিখানা থেকে ডিভিডি-র দোকান সর্বত্র টহল দিই। চায়ের দোকানের মধ্যে ক্যারম বোর্ডে খেলা চলে। টিভিতে হিন্দি ছবি বা খেলা। সঙ্গে চলতে থাকে নানা রাজনৈতিক আলোচনা। সে দিন দোকানে ঢুকতেই দেখি দোকানদার তাকে রাখা দেবদেবীকে ধূপ দিয়ে পুজো করছেন। আমি খুঁজছিলাম নতুন বাংলা ছবির ডিভিডি। দোকানদার নিজের গদিতে বসে মুখ খুললেন, ‘কী বলব দাদা! রোববারের সকাল। চিত্তরঞ্জন পার্কের এক নম্বর বাজারে কয়েক মাস আগেও ছিল অন্য চেহারা। কত খদ্দের। কত লোক। আর এখন দেখুন! মোদীজি আমাদের সর্বস্বান্ত করে দিল। বাজারে মানুষ নেই।’

Advertisement

সে দিন ছিল নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিন়। দোকানদার বললেন, গুজরাতে বুলেট ট্রেন হচ্ছে? লোক ঠকানোর জায়গা পায়নি বিজেপি! আরে মশাই যথেষ্ট রেললাইন নেই। রোজ দুর্ঘটনা হচ্ছে। রেলমন্ত্রীকেই নাকি সে জন্য বদলে দিতে হল। আর জাপান পয়সা দিয়ে আমাদের দেশে বুলেট ট্রেন বসিয়ে দিয়ে যাবে? দাদা, বাঙালকে হাইকোর্ট? তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখে বেশ বিস্মিতই হলাম। কারণ ক’দিন আগেও তিনিই মোদীজির প্রশংসায় মুখরিত ছিলেন। আমার বিস্ময়টা আঁচ করেই বোধহয়, তিনি বললেন, আসল ব্যাপারটা কী জানেন? অনেক আশা করেছিলাম। মানুষ যখন ভোট দিয়েছিল তখন তো ভেবেছিল চাকরি হবে। রোজগার বেড়ে যাবে। আমাদের গরিব মানুষের অ্যাকাউন্টে লক্ষ টাকা জমা হবে।

শুধু ওই এক জন দোকানদার নন, এই বাজারের মাছওয়ালা পর্যন্ত বেশ ক্ষিপ্ত। বাজারে নানা দলের লোক থাকতেই পারে। কিন্তু সাধারণ ভাবে ‘মুড’ দেখলাম বেশ স্বপ্নভঙ্গের। বাজারে আছে একটি ছোট্ট ঘড়ির দোকান। সেই ঘড়িবাবু বললেন, ‘‘আসলে গত তিন বছরে বাজারটা আর চড়ল না। যত দিন যাচ্ছে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে। সাধারণ মানুষের কাছে টাকা নেই। চাকরি নেই। বুলেট ট্রেনের ঘোষণায় কি চিঁড়ে ভিজবে?’’

Advertisement

মোদী-উপাসক লেখকরা বলছেন, কলকাতায় কত বছর আগে মেট্রো চালু হওয়ার কথা ছিল। বরকত গনি খান চৌধুরী তখন রেলমন্ত্রী। কিন্তু কলকাতায় এ প্রকল্প রূপায়ণ হতে কত বছর লাগল? এই দেরির জন্য, শুধু বাংলাই নয়, পূর্বাঞ্চলের ক্ষতি হয়েছে। এ বার বুলেট ট্রেন এসে যাওয়ায় ভারতের পশ্চিমাঞ্চলেও এক ব্যাপক উন্নতি আসবে। দেখুন কত তাড়াতাড়ি হয়! আমার কিন্তু মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গে দ্রুত মেট্রো রূপায়ণ হতে না পারার পিছনে একতরফা বাংলার কর্মসংস্কৃতিকে দায়ী করাটাও ঠিক নয়। এই প্রকল্প রূপায়ণে কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ মনোভাবও ছিল অনেকটাই দায়ী। দুর্ভাগ্য আজ যখন কোনও জোট সরকার নয়, ক্ষমতার মসনদে আসীন একক ভাবে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের বিজেপি, তখন বুলেট ট্রেন গুজরাত যায়। বাংলার জন্য শিকে ছেঁড়ে কই?

বুলেট ট্রেন পশ্চিমবঙ্গে হল না গুজরাতে হল, আজ আমার কাছে এটাই মৌল প্রশ্ন নয়। বুলেট ট্রেন চালু হওয়ার সংকল্প শুনতে বেশ ভালই লাগে। কিন্তু ভারতের সার্বিক আর্থিক ও সামাজিক পটভূমিতে এই বুলেট ট্রেন চালু করাই কি প্রকৃত অগ্রাধিকার? ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বুলেটকাহিনি সুখশ্রাব্য, কিন্তু দেশের নানা জনপদের প্রান্তিক মানুষের প্রকৃত উন্নয়নের গতিমুখ কি খুঁজে পাওয়া গেল এই বিগত তিন বছরে?

দুর্ভাগ্য, বাস্তব ছবিটি বুলেট ছবির বিপরীত। ধরুন, দিল্লি থেকে গাজিপুর, গাড়িতে যেতে দেড় ঘণ্টা লাগল। সেই গাজিপুর নামক এলাকাটিতে বয়ে চলেছে এক নদী। নদীর জলের রং কুচকুচে কালো। না এটি যমুনার কৃষ্ণরূপ নয়। এই হিন্দোন নদীটি দূষণ-আক্রান্ত। উত্তরপ্রদেশের পশ্চিম প্রান্তের বহু কারখানার বর্জ্য ও রাসায়নিক পদার্থ মিশে এই নদীটির এই রূপ। গাজিপুরই একমাত্র এলাকা যেখানে দিল্লির সমস্ত জঞ্জাল জমা হয়। জমা হতে হতে এখন এটি এক বিশাল পাহাড়। জঞ্জালের পাহাড়ে চাপা পড়ে সম্প্রতি মারা গিয়েছে কয়েক জন শিশু। তবু এই আবর্জনার মধ্যেই বসবাসকারী বহু পরিবার (যার মধ্যে অনেক বাঙালিও আছে) এই জায়গাটি ছেড়ে যেতে অরাজি। এই আবর্জনার মধ্যে থাকা এক কিশোর মিঠুন বললেন, এখানে ফেলে দেওয়া জলের বোতল, নানা ধরনের বর্জ্য পদার্থ বিক্রি করেই আমাদের ডাল-ভাত জোটে। এখান থেকে যাব কেন? যেমন এই আবর্জনার মধ্যে পাওয়া যায় মৃত মানুষের চুল। মৃত মানুষের আত্মীয়দের ফেলে দেওয়া চুল। এই চুল না কি পরচুলো ও অন্য আরও ব্যবসার জন্য বেশ ভাল দামেই বিক্রি হয়। মনে হচ্ছিল নরেন্দ্র মোদী তাঁর জন্মদিনে গুজরাতে না গিয়ে গাজিপুরে এই আবর্জনার গ্রামটিতে আসতে পারতেন। তাঁর নতুন ভারত দেখতে।

মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও সুশাসনের কথা ভাবলেও রাজনীতির সাফল্য অর্জনের কথা ভাবেননি। বিহার আর দিল্লিতে পরাজয়ের পর বিজেপি রণকৌশল বদলে ফেলে। মোদী বুঝতে পারেন সংস্কারের কথা বলায় দেশের শিল্পপতিরা তাঁর পাশে দাঁড়ালেও গরিব মানুষেরা কিন্তু তাঁর পাশে নেই। আর তাই উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে মোদী ধনীবিরোধী হয়ে দীনবন্ধু হতে উদ্যত হলেন।

এই কারণে ২০১৫ সাল থেকে বিজেপি দলিত তাস খেলা ও অম্বেডকর রাজনীতি শুরু করে যাতে বিজেপি বিরোধী মহাজোট তৈরি করা সম্ভব না হয়। ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল— বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে সুশাসনের দিকে মন দেন, লোকসান হয় রাজনীতির। বাজপেয়ী যে ভুল করেছিলেন, মোদী তা করতে চাইছেন না। ২০১৪ সালের ভোটও ছিল অভিনব। প্রায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্বাচনের মতো। আমজনতার গগনচুম্বী প্রত্যাশা ছিল মোদীর কাছে। ভোটে জেতার পর মোদী ভেবেছিলেন বাজার আরও উন্মুক্ত হবে, বেসরকারি উদ্যোগ আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে, বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি। তখন তিনি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচিকে গুরুত্ব দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু সে কাজেও সফল হওয়া যে সহজ নয় তা যত দিন যাচ্ছে তিনি বুঝতে পারছেন। মোদী হিন্দু নবজাগরণে বিশ্বাসী কিন্তু উগ্র হিন্দুত্ব করার এই আগ্রহ ২০১৪ সালে জেতার পর দেখিনি। তিনি ৭০ বছরের ভারতকে ‘ম্যানেজ’ নয়, পরিবর্তন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে মেরুকরণের রাজনীতির সামাজিক দাপট বাড়ছে দেশ জুড়ে। সেই ২০১৪ সালের ভোটের আগে থাকতে মোদীকে নিয়ে নিত্যনতুন বই প্রকাশিত হত। এখনও প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে নতুন নতুন বই। ফারাক একটাই। তখন সংস্কারমুখী এক নতুন ভারতের স্বপ্ন দেখানো হয় সে সব বইয়ে, এখন টীকাভাষ্যকাররা বলছেন হিন্দুত্বমুখী এক নয়া ভারতের কথা।

দেশের আর্থসামাজিক বদল না করেই বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন। এক মৃতকল্প ভারতের সুষ্ঠু চিকিৎসা না করে তার শরীরে আতর ছড়িয়ে লাভ কী?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন