কাণ্ডজ্ঞান বস্তুটি ক্রমেই বিরল হইতেছে। এখন স্মার্টফোনের স্ক্রিনে যাহা ভাসিয়া আসে, মানুষ সবেতেই বিশ্বাস করে। এবং, প্রাণপণে অন্যদের তাহা পাঠাইতে থাকে, চালু ভাষায় যাহার নাম ফরোয়ার্ড করা। কোনও এক ব্যক্তির হেফাজতে চারটি কিডনি রহিয়াছে, চাহিলেই মিলিবে; ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ইউনেস্কোর বিচারে দুনিয়ার সেরার শিরোপা পাইয়াছে; অথবা, ইদ উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার টানা পাঁচ দিনের ছুটি ঘোষণা করিয়া দিল— হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুকে পাওয়া প্রতিটি সংবাদই মানুষ বিশ্বাস করিয়াছে, এবং যথেচ্ছ ফরোয়ার্ড করিয়াছে। প্রথমত ভাবিয়া দেখে নাই, সংবাদপত্র যে খবরের হদিস পাইল না, সর্বত্র-হাজির টেলিভিশনের ক্যামেরা যে সংবাদকে ধরিতে পারিল না, প্রায়শ তেমন সংবাদ কোন জাদুতে মোবাইল ফোনের বার্তায় আসিয়া উপস্থিত হয়। দ্বিতীয়ত, ‘সংবাদ’টি ফরোয়ার্ড করিবার সময়ও তাহার সত্যতা যাচাই করিয়া দেখে নাই। ভাবে নাই, সংবাদটি ভুল হইলে অন্যদের পক্ষে তাহা অসুবিধা সৃষ্টি করিতে পারে কি না। মেসেজ ফরোয়ার্ড করিতে যে হেতু কার্যত কোনও খরচ এবং পরিশ্রম নাই, ফলে নিপা ভাইরাসের অব্যর্থ ঘরোয়া চিকিৎসাপদ্ধতি হইতে মোদীর জমানার আর্থিক সমৃদ্ধি, সর্বপ্রকার মেসেজ অবিশ্বাস্য হারে ফরোয়ার্ড করা হইতেছে।
‘ফেক নিউজ়’ হইতে কী ভাবে দাঙ্গা বাধিতে পারে, কী ভাবে মানুষের প্রাণহানি হইতে পারে, তাহার একাধিক নিদর্শন সাম্প্রতিক ভারত পাইয়াছে। তেমন মর্মান্তিক পরিণতি না হইলেও এই গোত্রের ভুয়া খবর বিবিধ অসুবিধা সৃষ্টি করিতে পারে। ইদ উপলক্ষে পরিবর্ধিত সরকারি ছুটির ভুয়া খবরটি তেমনই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করিল। অথচ, মেসেজটি যে সত্য নহে, ভুয়া, তাহা বুঝিতে গোয়েন্দা হওয়ার প্রয়োজন নাই। সামান্য কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করিলেই চলিত। ইদানীং মানুষ সেই পরিশ্রমেও নারাজ। তাহাই যদি হয়, তবে মেসেজ ফরোয়ার্ড করা হইতে বিরত থাকাই ভাল। মনে রাখা প্রয়োজন, ভুবনের ভারটি আমাদের উপর ন্যস্ত নহে। কোন হাসপাতালে নিখরচায় ক্যানসারের চিকিৎসা হইতেছে, কোন স্টেশনে একটি বাচ্চাকে খুঁজিয়া পাওয়া গিয়াছে, এই খবরগুলির প্রতিটিই জরুরি, কিন্তু সত্য হইলে। সত্যতা যাচাইয়ের পরিশ্রম যদি না পোষায়, অথবা তাহার উপায় না থাকে, তবে আক্ষরিক অর্থেই হাত গুটাইয়া রাখা প্রয়োজন। ভুয়া খবর ছড়াইয়া বিভ্রান্ত করিবার অন্যায়টি হইতে বিরত থাকা বিধেয়।
শাস্তির খাঁড়া ঝুলাইয়া দিলে কাণ্ডজ্ঞানটি দ্রুত ফিরিবে বলিয়াই অনেকের মত। ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুসারে এ হেন ভুয়া খবর ছড়াইবার অপরাধে কারাদণ্ড হইতে পারে। শাস্তির ভয় দেখাইয়া মানুষকে ঠিক পথে আনিতে হইবে, ইহা গণতন্ত্রের পক্ষে সুসংবাদ নহে। কিন্তু ইহাই বাস্তব। অর্থনীতির পরিভাষায় বলিলে, শাস্তির আশঙ্কা থাকিবার ফলে মেসেজ ফরোয়ার্ড করিবার ‘ব্যয়’ বাড়িবে। এবং, মনে করাইয়া দেওয়া প্রয়োজন, আইনের চোখে অজুহাতের ঠাঁই নাই। ‘আমি সত্য-মিথ্যা জানিতাম না’, অথবা ‘অনেকের কাজে লাগিতে পারে ভাবিয়াই মেসেজ ফরোয়ার্ড করিয়াছি’, বা ‘হাত লাগিয়া চলিয়া গিয়াছে’— এই গোত্রের কথা আইনের চোখে অর্থহীন। অতএব, মেসেজ পাইলেই ফরোয়ার্ড করিবার পূর্বে ঈষৎ ভাবিলে সকলেরই মঙ্গল।