আপনার অভিমত
Donald Trump

স্বামীজির নামের উৎকট উচ্চারণ অস্বস্তিতে ফেলেছে

বিবেকানন্দের নামের উচ্চারণ বিকৃতিতে মনের কোণে কোথাও যেন অসম্মানের খোঁচাটা বিঁধতেই থাকে। আমাদের প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে উপেক্ষার ভাষা শুনতে আমরা এখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি। বাস্তবজীবনে ও  ব্যক্তিগত ভাবে স্বামীজি নিজেও এই নামটাম নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামাননি কোনও দিন। যখন যে নাম জুটেছে সযত্নে গ্রহণ করেছেন।

Advertisement

দেবাশিস ভৌমিক

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২০ ০৪:৪৬
Share:

কয়েক সেকেন্ড বিরতিতে উচ্চারিত শব্দদ্বয় শ্রুতিগোচর করে বাঙালির তো মূর্চ্ছা যাবার দশা। আরে হচ্ছেটা কী! শিকাগোতে বক্তৃতা করে যে বাঙালি সন্ন্যাসী একদা থরহরি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন মার্কিন মুলুককে, সেই দেশের বড়কর্তার মুখে এ কী উচ্চারণ! বিবেকা...মুন্নন! কস্মিন কালেও বক্তা কখনও বিশ্বখ্যাত এই নামটি উচ্চারণ করেছেন বলে তো মনে হল না। রসিক এবং ক্ষমাশীল বাঙালি এই নামবিভ্রাট নিয়ে বড় একটা মাথাভারী করতে চাননি, এই যা রক্ষে।

Advertisement

বাস্তবজীবনে ও ব্যক্তিগত ভাবে স্বামীজি নিজেও এই নামটাম নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামাননি কোনও দিন। যখন যে নাম জুটেছে সযত্নে গ্রহণ করেছেন। মনে পড়বে, ১৮৮৭ সাল। সিমলের ছেলে নরেন সন্ন্যাস নিলেন। তাঁর নতুন নাম হল স্বামী বিবিদিষানন্দ। এই নব নামায়ণ নিয়েও তাঁর বিশেষ কোনও ভাবান্তর ছিল বলে শোনা যায় না। তবে এটা জানা যায়, স্বামীজি কখনও-সখনও নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে সচ্চিদানন্দ নামটি ব্যবহার করতেন। সন্ন্যাস জীবনের দীর্ঘ সময় তিনি গেরুয়া বসনে নগ্ন পায়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন গোটা ভারত। সেই সময়ে তিনি নিজের একাধিক নাম ব্যবহার করতেন। তবে তার মধ্যে ‘বিবেকা....মুন্নন’ যে ছিল না, তা হলফ করেই বলা যায়। শেষমেশ বিবেকানন্দ নামটি ধারণ করলেন ১৮৯৩ সালে। তখন তিনি আমেরিকা যাওয়ার জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়ে গিয়েছেন। শিকাগো ধর্মসভাতেও এই ভারতীয় মহাপুরুষের আবির্ভাব বিবেকানন্দ নামেই।

ভুল উচ্চারণকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ব্যবহার করবার দুষ্টবুদ্ধি কিন্তু স্বামীজির মধ্যেও একটুআধটু ছিল। স্বামীজির দেওয়া সে সব নামকরণ যে সবসময়ে হাসির ভিয়েন চড়াত, তা হয়তো নয়। দীক্ষা নেওয়ার পর মার্গারেটের নাম তিনি রেখেছিলেন নিবেদিতা। যথাযথ নামকরণ। অথচ, বিখ্যাত জাপানি শিল্পী ওকাকুরা কাকুজো-কে তিনি মজা করে ‘খুড়ো’ বলে ডাকতেন। ওকাকুরার খুুব ইচ্ছে ছিল স্বামীজিকে একবার হলেও তিনি জাপানে নিয়ে যাবেন। এই উদ্দেশ্যে বারবার তিনি বেলুড়মঠে আসতেন স্বামীজিকে অনুরোধ জানাতে। স্বামীজির ‘খুড়ো’ সম্বোধনে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্য আশ্রমিকেরাও সবাই ওকাকুরাকে ডাকতে শুরু করলেন ‘অক্রুর খুড়ো’ বলে।

Advertisement

এই ধরনের আরেকটি মজার ঘটনা আছে। জাপান থেকে এক জন বৌদ্ধসন্ন্যাসী ওকাকুরার সঙ্গে বেলুড়মঠে এসেছিলেন সংস্কৃত ভাষা শিখবেন বলে। তাঁর নাম ছিল ‘হোরি’। স্বামীজি তাঁকে এমন ভক্তি গদগদ কণ্ঠে ‘হরি’ বলে ডাকতেন যে সবাই আড়ালে হেসে ফেলত। যদিও হোরি বেশি দিন বেলুড়ে থাকেননি। স্বামীজির দেহান্ত হলে তিনি শান্তিনিকেতনে চলে যান। সেখানে রবীন্দ্রনাথের সাহচর্যও পান। কবি অবশ্য এই জাপানি অতিথিকে সম্বোধন করতেন ‘চিদানন্দ’ নামে।

আসলে নাম ব্যাপারটা অনেকটা যেন আমাদের শারীরিক প্রসাধনের মতো। পুরস্কার নেওয়ার সময়ে সঞ্চালকের ঘোষণায় নিজের নাম শুনলে শ্লাঘা জাগে। আবার কারও কাছে নাম ধরে অপমানের মুহূর্তে এই একই নাম হয়ে ওঠে বিষবৎ, ব্যর্থ রূপটান। এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট বক্তব্য, ‘‘বস্তুত নামটা পরিচয়ের জন্য নয়, ব্যক্তিনির্দেশের জন্য। পদ্মলোচন নাম নিয়ে আমরা কারো লোচন সম্পর্কীয় পরিচয় খুঁজি নে। একজন বিশেষ ব্যক্তিকেই খুঁজি। বস্তুত নামের মধ্যে পরিচয়কে অতি নির্দিষ্ট করার দ্বারা যদি নামমাহাত্ম্য বাড়ে তবে নিম্নলিখিত নামটাকে সেরা দাম দেওয়া যায়— রাজেন্দ্রসুনু শশিশেখর মৈমনসৈংহিক বৈষ্ণব নিস্তারিণীপতি চাকলাদার।’’ নামের এই দীর্ঘসূত্রিতার আড়ালে প্রকৃত মানুষটি হারিয়ে যান, তা কখনওই কাম্য নয়।

রোমান্টিক কবি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্ব ছিল কবি সুবোধ রায়ের। জীবনানন্দের কবিতার শিরোনাম প্রসঙ্গে এক বার সুবোধ রায় তাঁকে বললেন, ‘‘সত্যি ভারি মিষ্টি আপনার কবিতাগুলির নাম— ধূসর পান্ডুলিপি, আকাশলীনা, মনোকণিকা, সূর্যতামসী, নির্জন স্বাক্ষর।’’ অযাচিত প্রশংসা শুনে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো জীবনানন্দের ঠোঁটে। নরম সুরে বললেন, ‘‘তা নামের একটা আলাদা মহিমা, আলাদা মাধুর্য আছে বৈকি। এই ধরুন না, রবীন্দ্রনাথের নাম যদি হলুইদাস পতিতুন্ডি আর আমার নাম গদাধর তলাপাত্র হত, তা হলে কেমন শোনাতো বলুন তো?’’ বিদেশি অতিথির মুখে স্বামীজির নামের বিকট উচ্চারণে আমাদের সেই একই অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে।

প্রাজ্ঞ রবীন্দ্রভাষ্য বারবার মনে পড়ে যায়, ‘‘নাম জিনিসটা শব্দ বৈ আর কিছু নয়। কিন্তু সাধারণ লোকে আপনার চেয়ে আপনার নামটা বেশি ভালবাসে।’’ স্বামীজি আমাদের এতটাই আপনার যে তাঁর নামের বিকৃত উচ্চারণ আসলে আমাদেরই প্রত্যেকটি ভারতীয়কে আহত করে।

নামকরণের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তো ভারতে আজকের নয়। তাই আমাদের কানে স্বামীজির নামের ভুল উচ্চারণ একটু বেশিই কানে ঠেকেছে। ভারতীয় শাস্ত্র-পুরাণে নাম বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট মাথা ঘামিয়েছিলেন সংস্কৃত কবিরা। রবীন্দ্রনাথ তো বলেছেন— নামের সঙ্গে একটি ব্যক্তিমানুষের, একটি জাতির, একটি সংস্কৃতির যোগ জুড়ে থাকে। ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে লিখেছেনও সে কথা— ‘‘নামকে যাঁহারা নামমাত্র মনে করেন আমি তাঁহাদের দলে নই। শেক্সপীয়ার বলিয়া গেছেন, গোলাপকে যে কোনো নাম দেওয়া যাক তাহার মাধুর্যের তারতম্য হয় না। গোলাপ সম্বন্ধে হয়তো তাহা খাটিতে পারে। কারণ গোলাপের মাধুর্য সংকীর্ণ সীমাবদ্ধ। তাহা কেবল গুটিকতক সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষগম্য গুণের উপর নির্ভর করে। কিন্তু মানুষের মাধুর্য এমন সর্বাংশে সুগোচর নহে। তাহাকে আমরা কেবল ইন্দ্রিয় দ্বারা পাই না। কল্পনা দ্বারা সৃষ্টি করি। নাম সেই সৃষ্টিকার্যের সহায়তা করে।’’

স্বামী বিবেকানন্দের মতো এক জন ব্যক্তিবিশেষের নাম-তাৎপর্য উপলব্ধি করার সময় হয়তো পাননি ব্যস্ত বড়কর্তা।

প্রসঙ্গত আরেকটি মজার ঘটনা দিয়ে শেষ করা যাক। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বিশ শতকের গোড়ার দিকে একটি পত্রিকা বেরত। তাতে কখনও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, কখনও স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে নানা কটাক্ষসূচক লেখা প্রকাশ করতেন বাঁড়ুজ্জে মশাই। তা নিয়ে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের কোনও ভাবান্তর ছিল না। কিন্তু স্যর আশুতোষ তো রেগে তেলেবেগুন। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন কবির কাছে— ‘‘রবিবাবু, পাঁচকড়িকে নিয়ে তো আর পারা যায় না। যা তা লিখছে আপনার ও আমার সম্বন্ধে। লাইবেলের চার্জ এনে ওকে না ফাঁসালে আর চলে না। কী বলেন আপনি?’’ স্বভাবত শান্ত রবীন্দ্রনাথ ততোধিক শান্ত গলায় বললেন, ‘‘আহা! ওঁর কথায় কী মূল্য আছে বলুন তো? যিনি ওঁর সাক্ষাৎ জন্মদাতা—কিনা যিনি ওঁকে সবচেয়ে বেশি চিনতেন তিনি ওঁর নামকরণ করার সময় ওঁর পাঁচকড়ির বেশি মূল্য ধার্য করেননি।’’ কথাটা শুনে এ বার হো হো করে হেসে উঠলেন স্যর আশুতোষ। সব রাগ গলে জল।

তবুও মনের কোণে কোথাও যেন অসম্মানের খোঁচাটা বিঁধতেই থাকে। আমাদের প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে উপেক্ষার ভাষা শুনতে আমরা এখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি। প্রবাসী ভারতীয়দের কাছেও এই দম্ভের ভাষা নিশ্চিত ভাবে বিচলন তুলবে। বিদেশি অতিথির অসতর্ক উচ্চারণ শ্রুতিগোচর করে যতই একচোট হেসে নিই না কেন, সেই হাসির শব্দ বুকের গভীরে যে রক্ত ঝরিয়েছে— তা অস্বীকার করতে পারবেন না কোনও ভারতীয়ই।

বিভাগীয় প্রধান, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, কালিয়াগঞ্জ কলেজ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন