সম্প্রতি এক বৃদ্ধ দম্পতি খুন হইয়াছেন। অকুস্থল, অসমের চিরাং জেলা। ডাইনি অপবাদে হত্যা। অকুস্থলটি অসমের পরিবর্তে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর বা পুরুলিয়াও হইতে পারিত, ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ় বা উত্তরপ্রদেশের কোনও জেলা হওয়াও অস্বাভাবিক ছিল না। কারণ, ডাইনি অপবাদে হত্যা বিক্ষিপ্ত ভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটিয়া চলিলেও প্রবণতাটি দীর্ঘ কাল ধরিয়া অবিচ্ছিন্ন ভাবে চলিয়া আসিতেছে। প্রত্যন্ত গ্রামে অল্প ব্যবধানে পর পর মৃত্যু ঘটিলে তাহার দায় চাপানো হয় অশক্ত, অসহায়, একাকী অথবা নবাগত কোনও ‘ডাইন’-এর উপর। ঝাড়ফুঁক, তুকতাক, ওঝা, গুণিনের ক্ষমতায় অন্ধবিশ্বাসীদের মুহূর্ত লাগে না অপরাধীর শাস্তির ভারটি নিজ হস্তে তুলিয়া লইতে। দেশের নানা কোণে ঘটিয়া চলা এমন খবরের সামান্য অংশই গ্রামের বাহিরে আসে। ডাইনি অপবাদে হত্যা বা নির্বাসনের প্রকৃত সংখ্যাটি সম্ভবত সাধারণের ধারণারও বাহিরে। রাজ্যে পুলিশ-প্রশাসন আছে, এহেন ভয়ঙ্কর প্রথার অস্তিত্ব লইয়া তাঁহারা অবগতও আছেন। কিন্তু শুধু আইন করিয়া আর কে কবে ভ্রান্ত বিশ্বাস, কুসংস্কার দূর করিতে সফল হইয়াছে?
সফল হইত, যদি আইন প্রণয়নের সঙ্গে বিজ্ঞান চেতনাটিও মানুষের নিকট পৌঁছাইবার প্রচেষ্টাটি অব্যাহত থাকিত। ১৯৪৭-এর মধ্যরাত্রির ভাষণে নেহরু শুধুমাত্র ব্রিটিশ বিতাড়ন করিয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাদখলের কথা বলেন নাই। সেই ভাষণে ছিল এক নূতন দেশ গড়িবার স্বপ্ন, নূতন দিন আনিবার অঙ্গীকার। সংস্কারগ্রস্ত সমাজে সেই দিন আসিবে কী উপায়ে? বস্তুত, দেশ এবং দেশবাসীর সেবায় আত্মদানের যে কথা নেহরু বলিয়াছিলেন সেই কাজে স্বাধীন ভারতের নেতারা শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ। জনগণের সেবা তাঁহারা ততটুকুই করিয়াছেন, যতটুকু করিলে ভোটবাক্সে প্রতিফলনটি দেখা যাইবে। দেশ ও দশের চেতনা জাগ্রত করিয়া সার্বিক উন্নয়নের পথটি যেহেতু তুলনায় কঠিন, জনপ্রিয়তা হারাইবার সম্ভাবনাও অধিক— তাই দক্ষিণ-বাম সকল দলই ক্রমে তাহা হইতে সরিয়া দাঁড়াইল। বর্তমান ভারতের অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা এবং ধর্মীয় হিংসার পরিবেশ ইহারই ফল। সত্যকারের আলোকপ্রাপ্ত মানসিকতা নহে, বরং বৌদ্ধিক জড়তা এবং সংস্কারের অন্ধত্বকে সাদরে বরণ করিবার বন্দোবস্ত হইয়াছে সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতির নামে।
রাজনীতি তো তাহার দায়িত্ব ভুলিয়াছে। কিন্তু নাগরিক সমাজ? না, নাগরিক সমাজও তাহার দায়িত্ব পালন করে নাই। কয়েক দশক পূর্বেও বিভিন্ন পাড়ায় বিদ্যালয়, পাঠাগার এবং ক্লাবগুলিতে নিয়মিত বিজ্ঞান প্রদর্শনী আয়োজনের রেওয়াজ ছিল। শুধুই কেতাবি শিক্ষা নহে, প্রাত্যহিকতার সঙ্গে যুক্ত সংস্কারগুলির অসারতা ব্যাখ্যা করিয়া ‘যুক্তি’ তুলিয়া ধরার তাগিদ ছিল। বর্তমানে সেই তাগিদ উবিয়াছে। সরকারি ও অসরকারি তরফে কিছু বিক্ষিপ্ত চেষ্টা চলিলেও প্রয়োজনের তুলনায় তাহা নিতান্ত অনুল্লেখযোগ্য। বাস্তবিক, যাবতীয় সংকীর্ণতা, অন্ধবিশ্বাস দূর করিয়া সমাজের পরিশোধক হিসাবে বৈজ্ঞানিক চেতনার প্রয়োজনীয়তাটিই ক্রমশ গুরুত্ব হারাইয়াছে। নাগরিক সমাজের এই ব্যর্থতার কারণটিও শেষ বিচারে রাজনৈতিক। রাজনীতি ভোট নামক লাভ-লোকসানের বাহিরে বৌদ্ধিক বিকাশের পথটি নাগরিককে দেখায় নাই। অন্যায় সংস্কার রুখিবার প্রতিজ্ঞা হইতে সমাজকে সরাইয়া আনিয়াছে।