সম্পাদকীয় ২

বিনোদনের দাম

বাস্তবিক, জাল্লিকাট্টু লইয়া এত দিন অধিকাংশ বিতর্কেরই ভরটি থাকিয়াছে পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতার উপর। যে কোনও মুক্ত সমাজে পশুর অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সন্দেহ নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৫২
Share:

জীবনের অধিকার বনাম ঐতিহ্যের অধিকার: জাল্লিকাট্টু রাজনীতির সংক্ষিপ্তসার ইহাই। তামিলনাড়ুর পোঙ্গল উৎসবকালীন এই খেলাটি যে অতীব বিপজ্জনক, তাহাতে কাহারও দ্বিমত নাই, এমনকী যাঁহারা জাল্লিকাট্টুর পক্ষে প্রতিদিন গলা ফাটাইতেছেন, মিটিং-মিছিল-অনশন করিতেছেন, তাঁহারাও এ বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত। তাঁহাদের যুক্তি, বিপদ থাকুক আর না থাকুক, এত দিনের ঐতিহ্যকে কি এই ভাবে বন্ধ করিবার অধিকার কাহারও আছে? বিপরীতে, অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ার বোর্ড অব ইন্ডিয়া কিংবা পিপল ফর এথিক্যাল ট্রিটমেন্ট টু অ্যানিমালস (পেটা) নামক যে সব সংগঠন ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে তামিলনাড়ু রাজ্যের আইনের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকিয়াছিল, এবং উৎসব বন্ধের নির্দেশ পাইয়া জয়লাভ করিয়াছিল, তাহাদের যুক্তি— ঐতিহ্যের মধ্যে যদি অন্যায় থাকে, তবে সেই ঐতিহ্য প্রয়োজনে বাতিল করিতে হইবে বইকি। অর্থাৎ মামলা বা আন্দোলন বিনোদনের ঐতিহ্য বা পশুপ্রেমের নামে চলিলেও জাল্লিকাট্টুর সারাংশ এই অধিকার বনাম অধিকারের প্রশ্নটিই।

Advertisement

বাস্তবিক, জাল্লিকাট্টু লইয়া এত দিন অধিকাংশ বিতর্কেরই ভরটি থাকিয়াছে পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতার উপর। যে কোনও মুক্ত সমাজে পশুর অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সন্দেহ নাই। এই অধিকারের উপর সভ্যতার পরিমাপ নির্ভর করে বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু তাহার পরও একটি কথা থাকিয়া যায়। শুধু কি পশুর অধিকারই এই উৎসবে বিপন্ন হয়? মানুষের অধিকার কি খর্ব হয় না? ২০১৭ সালে এই খেলায় ৫টি বৃষের সঙ্গে পনেরো জনের মৃত্যু হইয়াছে, ১৯৫০ জন মানুষ আহত হইয়াছেন। মৃতদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীরা যেমন আছেন, তাণ্ডবের ফলে মানুষকে বাঁচাইতে ছুটিয়া যাওয়া কতিপয় পুলিশও আছেন। এই বৎসর জানুয়ারিতে উৎসবটি ফিরিয়া আসিলে আবারও ৪ জনের মৃত্যু ঘটে। যাঁহারা প্রাণ দিতেছেন, তাঁহারা সম্পূর্ণ সজ্ঞানে বা স্বেচ্ছায় প্রাণ দিলেও প্রশ্নটি উঠিবেই, প্রকাশ্য দিবালোকে রক্তলোলুপ ক্রীড়া আয়োজনের মাধ্যমে মৃত্যুবরণের ‘স্ব-ইচ্ছা’ কার্যকর করানো কি কোনও গণতান্ত্রিক দেশের দস্তুর হইতে পারে? কী বলেন তামিল ঐতিহ্যবাদীরা?

তামিল বিধানসভায় যে সংশোধনী আইন দ্বারা সু্প্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞার পাশ কাটাইয়া এই প্রাণঘাতী উৎসব চালু রাখিবার সিদ্ধান্ত হইয়াছে, তাহার পক্ষে একটিই যুক্তি থাকা সম্ভব। ঐতিহ্যের স্বার্থে যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করিয়া প্রথাটি চালু থাকিতে পারে। সমস্যা কিন্তু এই ‘যথাযথ’র মধ্যেই। এ বারের ঘটনা দেখাইয়া দিল, প্রাণঘাত আটকাইবার মতো যথেষ্ট সতর্কতা প্রশাসনের পক্ষে লওয়া কেন অসম্ভব। এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি সংখ্যক খেলা বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত হয় যে সর্বত্র সর্বোচ্চ স্তরের নিরাপত্তা দেওয়া দুরূহ। বিশেষত, উত্তেজিত বৃষরা যাহাতে ব্যারিকেড না ভাঙে তাহা নির্ভর করে কেবল বৃষদের সংবেদনশীলতার উপরই। বাহির হইতে ক্রুদ্ধ, অনাহারধ্বস্ত বৃষদের দিয়ে ব্যারিকেড মানাইয়া চলা অসম্ভব। এ বারের অভিজ্ঞতাই প্রমাণ। নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা না গেলে একটি পথই খোলা থাকে— নিষেধাজ্ঞা। ঐতিহ্যের আবেগ ভাল। কিন্তু নিরীহ প্রাণের বিনিময়ে সেই আবেগের তোষণ চলে না।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement