কয়েকটা অতি-বৃহৎ ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি মানেই দেশের উন্নতি নয়

বৃদ্ধি হচ্ছে, জা্‌নতি পারো না

ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে বা এনএসএসও তার শেষ রিপোর্টে বলছে, গত ৪৫ বছরের মধ্যে বেকারত্বের হার এখন সবচেয়ে বেশি— ৬.১ শতাংশ। ২০১২ সালে হয়েছিল ২.২ শতাংশ।

Advertisement

ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৯ ০০:০১
Share:

—ফাইল চিত্র।

জেট এয়ারওয়েজ়-এর সলতে নিভল, অন্তত কুড়ি হাজার চাকরিও গেল। সরকারি টেলিকম সংস্থা বিএসএনএল চুয়ান্ন হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করার জন্য প্রস্তুত বলে খবর এল, শুধু ভোটের জন্যই সেই ঘোষণা আটকে। শুধু সরকারি নয়, এক রাঘব বোয়ালের দাপটে বেসরকারি টেলিকম ক্ষেত্রেও রক্তগঙ্গা বইছে— এক বছরে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন।

Advertisement

এই ধরনের কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র ছাড়িয়ে দেশের সামগ্রিক ছবিটা এক বার দেখা যাক। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি বা সিএমআইই তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে জানিয়েছে, ২০১৮ সালে এক কোটির বেশি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চুরাশি শতাংশ গ্রামীণ মহিলা। সিএমআইই-র অন্য একটি তথ্য বলছে, দেশে এই মুহূর্তে ৩ কোটির বেশি শিক্ষিত বেকার কাজ খুঁজছেন। এই ভয়াবহতার ছবি উঠে এসেছে অক্সফ্যাম ইন্ডিয়া-র রিপোর্টেও।

আর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে আজ়িম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়, যাতে দেখা যাচ্ছে গত দু’বছরে পঞ্চাশ লক্ষ পুরুষ কাজ হারিয়েছেন, মহিলা শ্রমিক সংক্রান্ত তথ্য সেখানে নেই। শোনা গিয়েছে, ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে বা এনএসএসও তার শেষ রিপোর্টে বলছে, গত ৪৫ বছরের মধ্যে বেকারত্বের হার এখন সবচেয়ে বেশি— ৬.১ শতাংশ। ২০১২ সালে হয়েছিল ২.২ শতাংশ। কিন্তু এই রিপোর্ট সরকারের তরফে প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। প্রতিবাদে এনএসএসও-র দুই শীর্ষকর্তা পদত্যাগ করেছেন। সিএমআইই থেকে শেষ প্রকাশ, এপ্রিলের প্রথম তিন সপ্তাহে এই হার ৮ শতাংশ ছুঁয়েছে।

Advertisement

সংখ্যার একটু তারতম্য থাকলেও সব রিপোর্টের মূল সুর এক। ভারতের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ পঁচিশ বছরের নীচে। এক সময় এই তারুণ্যকে দেশের সম্পদ মনে করা হত, কিন্তু আজ তা প্রায় বিভীষিকায় পরিণত হতে বসেছে। প্রতি বছর প্রায় পৌনে দুই কোটি যুবক-যুবতী কাজের বাজারে এসে পড়ছেন, সে ইঞ্জিনিয়ার হোক বা স্কুল ড্রপআউট। কিন্তু কাজের সুযোগ বাড়া তো দূরস্থান, গত কয়েক বছরে সমানেই কমছে। ইঞ্জিনিয়ারিং বা উচ্চশিক্ষার অন্যান্য ক্ষেত্রে চাকরির সমস্যা নিয়ে তো অনেক কথাই লেখা হয়েছে— এঁদের প্রায় ৮৫ শতাংশ পাশ করার পরেও কাজ পাওয়ার যোগ্য নন, আর চাকরিও হাতেগোনা। কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্র, যেখানে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন, সেখানেও কাজে ভাটার টান সত্যি একটা বড়সড় প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে দেশের ভবিষ্যৎকে।

এ ছাড়াও আছে সামাজিক টানাপড়েনের এক ধিকিধিকি আগুন, যার কথা উঠে এসেছে সাংবাদিক নিখিলা হেনরির লেখা ‘দ্য ফারমেন্ট: ইউথ আনরেস্ট ইন ইন্ডিয়া’ বইটিতে। গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন আর বিক্ষোভ— দলিত-বহুজন, আদিবাসী, মুসলিম, কাশ্মীরি— এগুলি আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন মনে হলেও কোথাও কি এরা এক সূত্রে গাঁথা? রোহিত ভেমুলার ঘটনা দিয়ে বইটির শুরু, কিন্তু তার পর এক সাংবাদিকের চোখ দিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন একের পর এক ঘটনা। কোথাও যাদবপুর থেকে জেএনইউ হয়ে ভীম আর্মি— সব মিলে যায় একই ক্যানভাসে। ঘটনাগুলোর রূপ ও গঠন আলাদা হলেও প্রতিবাদের ভাষাটা কোথাও এক। শিক্ষা, জীবিকা ও অন্য প্রতিষ্ঠানে উচ্চবর্ণের মৌরসিপাট্টা ভাঙতে চাইছে আজকের যুবসমাজ। সংবিধান তাদের সুযোগের এক্তিয়ার দিয়েছে, কিন্তু আগলটা ভাঙেনি। যুবসমাজের একটা বড় অংশ তাই নিজভূমে পরবাসী হয়ে থাকার হতাশায় চঞ্চল, অস্থির।

এই ফাটল আজকের নয়, কিন্তু বালিতে মুখ গুঁজে উটপাখি হয়ে থাকতে পারলেই নিশ্চিন্ত আমরা। রোহিত ভেমুলা কাণ্ড হয়তো কোথাও এই স্থবিরতাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তফসিলি জাতি, জনজাতি, দলিত ও অন্যান্য পিছিয়ে থাকা জনজাতি, আর সংখ্যালঘু— সব মিলিয়ে দেশের প্রায় এই ৮৫ শতাংশের সঙ্গে বাকি ১৫ শতাংশের সম্পর্ক গত কয়েক বছরে এক মন্থনের আবর্তে পাক খাচ্ছে। খানিক দিশেহারা হয়েই শাসক দল তাদের ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বা ‘আরবান নকশাল’ তকমা দিয়ে সমস্যার সরলীকরণে ব্যস্ত। এক দিকে একবগ্গা উগ্র জাতীয়তার পিঠে সওয়ার রাষ্ট্রশক্তি, অন্য দিকে বিভিন্ন জাতীয়তার বহুত্বে নিজের দেশকে খুঁজতে থাকা যুবশক্তি, এই দুই পক্ষ আজ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

ফিরে আসা যাক জীবিকার বিষয়ে। বিশ্ব জুড়ে প্রযুক্তির যা অভিমুখ— এক অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মেশিন ও কম্পিউটার কেবল মানুষের কায়িক কাজকে নয়, চিন্তা আর মননকেও অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলছে। ফলে বড় শিল্পে চাকরি সৃষ্টির সম্ভাবনা ক্রমেই কমছে। গুজরাত থেকে বাংলা, বিভিন্ন শিল্প সম্মেলনে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্পের যে আস্ফালন শোনা যায়, তাতে জীবিকার সংস্থান হয় নামমাত্র। যে কয়েকটি প্রকল্প দিনের আলো দেখে, তাতে প্রায় পুরো টাকাটাই চলে যায় এক কোম্পানি থেকে আর এক কোম্পানির পকেটে, কর্মীর বেতনের খরচ কোনও হিসেবের মধ্যেই আসে না। অথচ আজ ভারতের মতো দেশে আর্থিক বৃদ্ধির হার অন্তত ৭ শতাংশ চাই শুধু জীবিকার বর্তমান সুযোগটুকু ধরে রাখতে। ইউপিএ-র দশ বছরে বৃদ্ধির গড় ছিল ৮ শতাংশের একটু বেশি। গত পাঁচ বছরে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশে, তাও ভিত্তিবর্ষে ওলটপালট ঘটিয়ে, প্রকৃত হার নিয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। ফলে জীবিকার ক্ষেত্রে যে মন্দা হবে, তা বলাই বাহুল্য। শুধু নীতি আয়োগের গুপি-বাঘা ভরসাফুর্তির ঢোল বাজিয়ে চলেছে— বৃদ্ধি হচ্ছে, চাকরিও বাড়ছে, তোমরা শুধু জা্‌নতি পারো না!

নোটবন্দির পর দুই বছরের বেশি অতিক্রান্ত। অসংগঠিত শিল্প আর কৃষিতে তার অভিঘাত এখনও দগদগে। কালো টাকা প্রহেলিকাই থেকে গিয়েছে, উগ্রপন্থা কয়েক গুণ বেড়েছে, ক্যাশলেস অর্থনীতি এমন যে নোটের জোগান ৭ শতাংশ বেড়েছে। মাঝখান থেকে অন্তত কোটিখানেক মানুষ কাজ হারালেন। অসংগঠিত শিল্পের যে সব ক্লাস্টার গড়ে উঠেছে গত কয়েক দশক ধরে, সেখানে প্রচুর মানুষ কাজ করেন। নোটবন্দির ভয়াবহ প্রকোপে সেখানে আজ প্রায় শ্মশানের স্তব্ধতা। কোয়েম্বত্তূরের শিল্পাঞ্চলে প্রায় ৪০০০০ ছোট কারখানা বন্ধ, তিরুপুর বা সুরাতের বস্ত্রশিল্পে ৪০ শতাংশের ঝাঁপ বন্ধ, মোরাদাবাদের কাচশিল্প ধুঁকছে, কানপুর-উন্নাওয়ের চর্মশিল্প লাটে ওঠার জোগাড়। কাজ হারিয়ে ঘরে ফিরে যাওয়া লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের চাপে গত দুই বছরে ‘মনরেগা’ বা একশো দিনের কাজে বরাদ্দ বাড়াতে হয়েছে।

দশ-পনেরোটি অতি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর শ্রীবৃদ্ধি যে দেশের উন্নয়নের মডেল হতে পারে না, সেই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? বড় শিল্প তো বাজার অর্থনীতির ছন্দে চলার কথা। সরকারের উদ্যোগ করার কথা ছিল শ্রমনিবিড় ক্ষেত্রগুলোর বিকাশে, আর তার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি, কর্মসূচি আর বাজেট বরাদ্দে। এই মডেলের খোঁজ মিলতে পারে বাংলাদেশ বা ভিয়েতনােমর দিকে তাকালে।

কিন্তু এই সব ছোটখাটো বিষয়ে আমল দেওয়ার সময় কোথায়? ভোট আসতেই তাই ভূতের ফাঁকির মতো মিলিয়ে গিয়েছে গুজরাত মডেল, ‘অচ্ছে দিন’, ‘সব কা বিকাশ’, কোটি কোটি চাকরি, মেক ইন ইন্ডিয়া, স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া, স্কিল ইন্ডিয়া। নতুন ভারত গড়তে এখন হাতে রইল রামনবমীর তরোয়াল নৃত্য, বানরসেনা, পাকিস্তান, ঘুসপেটিয়া, সাধ্বীর অভিশাপ, গোমূত্র, পরমাণু অস্ত্রে দীপাবলি, কাশীর ঘাটে আরতি আর একুশ শতকের তরুণ সমাজের জন্য সেই অমোঘ আহ্বান: তোমরা আমাকে ভোট দাও, আমি তোমাদের বালাকোট দেব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন