ফাইল চিত্র।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরের মধ্যে এখন রাত সাড়ে আটটা হইতে সকাল ছ’টার মধ্যে কোনও ব্যক্তি পরিচয়পত্র ছাড়া প্রবেশ করিতে পারিবেন না। একই ভাবে, ওই সময়ে গাড়ি বা অন্য যানবাহনও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক পার করিতে পারিবে না। সম্প্রতি এই সংস্কার ঘটিল। কেন ঘটিল, তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। গত কয়েক বৎসর ধরিয়া এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এত রকমের ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে, এবং তাহাতে এত প্রকার নিরাপত্তার অভাব তৈরি হইয়াছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে পরিস্থিতি সামলানোর আবশ্যিক ধাপ এই কড়াকড়ি। নিরাপত্তার অভাবের সঙ্গে অবশ্যই মাদকদ্রব্য সেবন ও মদ্যপানের বিষয়টিও জড়িত। যুবসমাজের মধ্যে মাদক ও মদ্য সেবনের মাত্রাটি সম্প্রতি এমনই সীমা ছাড়াইতে বসিয়াছে যে তাহার নিয়ন্ত্রণের জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সীমানা আগলাইবার কথা ভাবিতে হয়। বাস্তবিক, কেবল যাদবপুর কেন, নেশার বিষয়টি এখন সকল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়া ভাবিতে হইতেছে। নেশা যিনি করিতেছেন, নেশা তো কেবল তাঁহারই বিপদ ডাকিয়া আনে না, চার পাশের মানুষদেরও বিপদে ফেলিতে পারে। সুতরাং সাবধানতা এখন অতি আবশ্যিক।
প্রশ্ন উঠিবেই। প্রশ্নগুলি সঙ্গতও। বিশ্ববিদ্যালয় বস্তুটির প্রয়োজনীয় শর্ত, মুক্তি। যে মুক্তি ব্যতিরেকে সারস্বত চেতনার প্রকৃত স্ফুরণ সম্ভব নয়। যে মুক্তি ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব উন্মীলন পর্বে তাহাকে উড়িবার আকাশ দেয়, পক্ষ বিস্তার করিয়া জীবনের প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিত বিবিধ পরিস্থিতির স্বাদ পাইতে দেয়। রাত সাড়ে আটটা হইলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ করিবার মধ্যে সেই মুক্তিটিকে ব্যাহত করিবার প্রয়াস আছে, তাহা বলিয়া দিতে হয় না। অতঃপর সাড়ে আটটার পর, বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের ছাত্রছাত্রীদের বন্ধুবান্ধবরাও আর চত্বরে ঢুকিতে পারিবেন না। পশ্চিম দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ভাবিলেই বোঝা সম্ভব, এই ব্যবস্থা কতটা দুর্ভাগ্যজনক।
সন্দেহ নাই, এই সব সঙ্গত প্রশ্ন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্রছাত্রী, গবেষক, শিক্ষকদের পীড়া় দিতেছে— এমনকি প্রাক্তনীদেরও। তাঁহারা সকলেই নিজেদের প্রতিষ্ঠান বিষয়ে গর্ব করিবার সময়ে বলিতেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এক ও অনন্য, কেননা তাহা এতখানি খোলামেলা। বস্তুত, এই বিশ্ববিদ্যালয় এত দিন কলিকাতার, হয়তো রাজ্যেরও, মুক্ততম শিক্ষাপ্রাঙ্গণ ছিল বলিলে ভুল হইবে না। অনেকেই নিশ্চয় যুক্তি দিবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষ মানটির সহিতও সেই মুক্তির একটি ঘনিষ্ঠ সংযোগ আছে। যুক্তির দিক দিয়া এই সকলই সত্য। তবে কিনা, বিপরীত যুক্তিটিও নেহাত ফেলনা নয়। উৎকর্ষই যখন মুক্তির কারণে বরবাদ হইতে বসে, তখন কোনটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, সংস্কারপন্থীরা সেই প্রতিপ্রশ্ন তুলিবেনই। ইহা কেবল প্রশাসনের বাড়াবাড়ির সমস্যা নয়। ছাত্রছাত্রী ও তাহাদের পরিপার্শ্বের সমাজটিরও সমস্যা। মুক্তির সুযোগের অপব্যবহার করে সেই সমাজ। সন্দেহ নাই, রাজ্যের অন্যতম উৎকৃষ্ট শিক্ষাপ্রাঙ্গণের দরজা যখন আংশিক ভাবেও বন্ধ করিয়া দিতে হয়, তখন এই রাজ্য বিষয়েও দুই-চারিটি ছবি সর্বসাধারণের চোখের সামনে ফুটিয়া উঠে। সে বড় সুখের ছবি নহে।