আমরা কি সাহারা হতে চাইছি

এই পরিস্থিতিতে সম্প্রতি যশোর রোডের গাছ-কাটাকে কেন্দ্র করে রাজ্যের সার্বিক পরিবেশ আন্দোলন নতুন অক্সিজেন পেয়েছে।

Advertisement

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৭ ১৩:১১
Share:

চার পাশে তাকালে মনে হবে, এ রাজ্যে পরিবেশ আইন ও তার প্রয়োগের বিষয়টি যেন আলমারিতে চাবি দিয়ে রাখা আছে! বামফ্রন্ট সরকারের শেষ পাঁচ বছর আর তৃণমূল সরকারের প্রথম ছ’বছরে পরিবেশকে গুরুত্ব না-দেওয়ায় আশ্চর্য মিল ও ধারাবাহিকতা। কিছু পরিবেশবিদ কখনও আদালতে, কখনও রাস্তায় নেমে আন্দোলন করলেও তার দৌড় বড়জোর কাগজের শিরোনামেই থেমে যায়, রাজনৈতিক ও সরকারি অচলায়তনের পরিবেশকে স্রেফ পাত্তা না-দেওয়ার মানসিকতায় দাঁত বসাতে পারে না, কারণ ভোট-কেন্দ্রিক রাজনীতির ভাষায় পরিবেশের ‘নম্বর নেই’।

Advertisement

এই পরিস্থিতিতে সম্প্রতি যশোর রোডের গাছ-কাটাকে কেন্দ্র করে রাজ্যের সার্বিক পরিবেশ আন্দোলন নতুন অক্সিজেন পেয়েছে। মার্চের শেষ দিকে যশোর রোডের বনগাঁর প্রান্ত থেকে শুরু হয়েছিল সবুজ নিধন যজ্ঞ! যশোর রোডকে চওড়া করার জন্য (কেউ কেউ বলছেন বেশ কয়েকটি উড়ালপুলের জন্যও) নাকি চার হাজার গাছ কাটতে হবে! যাবতীয় প্রশ্ন ও নিয়ম শিকেয় তুলে কয়েকশো বছর পুরনো গাছদের দেহে পড়তে শুরু করল কুড়ুলের কোপ। অধিকাংশই সরে পড়েছিলেন। কিন্তু সরেননি কিছু অল্পবয়স্ক, অধিকাংশই কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়ে। ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ-এর মাধ্যমে আরও বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী, এমনকী বড়রাও জুটে গিয়েছিলেন। যারা গাছ কাটছে, তাঁরা তাদের কাছে সরাসরি গিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে কাগজপত্র দেখতে চান। নানা ভয় দেখানো, নেতানেত্রীর নাম করে চোখ লাল— ইত্যাদিতেও কাজ না হওয়ায় গাছ কাটিয়েরা রণে ভঙ্গ দেয়। পরবর্তী কালে আদালতে মামলা ওঠে ও সেখানেও এটা মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায়, আইনসম্মত ভাবে গাছগুলি কাটা হচ্ছিল না। আদালতের রায়ে এখন বন্ধ রয়েছে গাছ কাটা।

কিন্তু বন্ধ হয়নি গাছ কাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন। সবুজ ধ্বংসের প্রতিবাদে বনগাঁ থেকে বারাসত অবধি বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে পথসভা। এমনকী মে মাসের প্রবল গরমে সবুজ বাঁচাতে দীর্ঘ পথ হাঁটাও। উপরন্তু, এর স্ফূলিঙ্গ ক্রমেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভর করে ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যের আরও নানা অঞ্চলে। কখনও টাকি রোডের গাছ কাটার বিরুদ্ধে, কখনও চাকদা রোডে কাটা গাছের জায়গায় নতুন চারা বসিয়ে তাদের রক্ষা করার প্রতিজ্ঞায়। এমনকী কেউ কেউ গাছকে জড়িয়ে চিপকো আন্দোলনের রাস্তায় বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে কোথাও গাছ কাটার খবর পেলেই ছুটে গেছেন অনেকে। এবং কী আশ্চর্য! প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সরকার বা সরকার-মনোনীত সংস্থা আইন ভেঙে গাছ কাটছে! এই আন্দোলন ছড়িয়েছে সুদূর উত্তরবঙ্গের লাটাগুড়িতে আদিবাসীদের মধ্যে, গোঘাটের কাছে ভাবাদিঘি-তেও। কোথাও উড়ালপুলের জন্য নিয়ম ভেঙে গাছ কাটা শুরু হয়েছিল; কোথাও বা ট্রেনের লাইন বসাতে দিঘি ভরাটের পরিকল্পনা হচ্ছিল। এমনকী কলকাতার উপকণ্ঠে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া ও আদালতের রায়ে সংরক্ষিত পূর্ব কলকাতার জলাভূমি চিরে রাজ্য সরকারের উড়ালপুল তৈরির পরিকল্পনার বিরুদ্ধেও দানা বাঁধছে আন্দোলন।

Advertisement

তা হলে কি একটিও গাছ কাটা, বা একটিও জলাশয় ভরাট করা যাবে না? তবে উন্নয়ন হবে কোন পথে? ‘উন্নয়ন কাকে বলে’, সেই বড় বিতর্কে না-ঢুকেও বলা যায়, নিশ্চয়ই গাছ কাটতে হবে, জলা ভরাট করতে হবে। কিন্তু উপযুক্ত কারণ থাকা দরকার। আর সেটা প্রমাণের জন্য প্রয়োজন ঠিক তথ্যের। সাহারার পাশে মারাকেশ শহরে জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে আন্তর্জাতিক আলোচনাতে উপস্থিত থাকতে গিয়ে দেখেছিলাম কী ভাবে সযত্নে একটি গাছ বাঁচাতে বাড়ির দেওয়াল ফুটো করে গাছটির যাওয়ার পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। পাশে সাহারা বলেই কি সবুজের প্রতি এত আকর্ষণ! আমরাও কি তবে সাহারা হওয়ার প্রতীক্ষায় থাকব? প্রশ্নটা উঠছে, কারণ সারা পৃথিবী আজ সবুজ বাঁচাতে নেমেছে। কেননা, ক্রমবর্ধমান কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস সামলাতে, রেকর্ড ভাঙা উষ্ণায়ন থামাতে গাছই যে অন্যতম ভরসা, তা বুঝছে সবাই। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে আমাদের দেশে ও আমাদের রাজ্যের উলটপুরাণের খেলা। এক দিকে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে লক্ষ লক্ষ গাছ লাগানোর ঘোষণা, অন্য দিকে নীরবে, মূলত অপ্রয়োজনে গাছ কাটার যজ্ঞ। তা সে সল্ট লেকের রাস্তাই হোক, বা মানকুণ্ডু ও শান্তিপুরের আমবাগান। এমনকী ম্যানগ্রোভ কাটলে সুন্দরবন ধ্বংসের মুখে পড়বে, এ কথা বিলক্ষণ জেনেও সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ!

আর ঠিক এখানেই রাজ্যের পরিবেশবিদদের ঠিক ভূমিকা নেওয়া উচিত। এক দিকে যেমন সোশ্যাল মিডিয়ার আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশ আন্দোলনকে আরও অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন, কেননা গণতন্ত্রে প্রভাব বিস্তারের ফর্মুলায় ‘নাম্বার’ চাই; অন্য দিকে তেমন প্রয়োজন ‘রাইট টু ইনফরমেশন’ বা অন্যান্য পথ ধরে উপযুক্ত তথ্য জোগাড়ের মাধ্যমে সরকারের অপ্রয়োজনীয় ও কার্যবিশেষে বেআইনি পরিকল্পনাকে মোকাবিলা করা। বিংশ শতাব্দীর ১ এপ্রিলের পরের আন্দোলন খানিকটা হারিয়ে গিয়েছিল ঠিক দিকনির্দেশের অভাবে; একবিংশ শতাব্দীর ১ এপ্রিল আন্দোলনের যে নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে, তাকে সফল করতে হলে চাই ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া। কাজটা কঠিন, কেননা এ ধর্মযুদ্ধে রাজনীতিক, পেজ ফোর ও প্রাইম টাইম বিদ্বজ্জনদের অধিকাংশই নেই। আবার কাজটা সহজও বটে। কারণ যশোর রোডের আন্দোলন দেখিয়েছে, সঙ্গে সাধারণ মানুষও থাকবে। যত পৃথিবী উষ্ণ হবে, যত নদী শুকোবে, যত জঞ্জাল উপচে পড়বে, তত আরও বেশি করে থাকবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন