জলাশয়ের স্বাস্থ্য: চিন্তাভাবনা শুরু হওয়া দরকার

এই তিন সায়রের ইতিহাস সম্পর্কে বর্ধমানবাসী কমবেশি জানেন। কিন্তু, এই তিনটি পুরনো সায়রের অবস্থা দিনে দিনে পরিবেশপ্রেমীদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে। কারণ, এই সায়রগুলিতে দূষণ বাড়ছে। লিখছেন গিয়াসুদ্দিন সিদ্দিকি ও অরিত্র বসাক‘সায়র’ বলতে বড় দিঘি বা সরোবরকেই বোঝায়। বর্ধমান শহরের বাসিন্দাদের জলকষ্ট মেটাতে বর্ধমানের রাজারা শ্যামসায়র, কৃষ্ণসায়র ও রানিসায়র খনন করান।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:৩২
Share:

শ্যামসায়রের পাড়ে জমেছে আবর্জনা। ছবি: উদিত সিংহ।

‘সায়র’, এই শব্দটি বর্ধমান শহরের বাসিন্দাদের কাছে পরিচিত। ‘সায়র’ বলতে বড় দিঘি বা সরোবরকেই বোঝায়। বর্ধমান শহরের বাসিন্দাদের জলকষ্ট মেটাতে বর্ধমানের রাজারা শ্যামসায়র, কৃষ্ণসায়র ও রানিসায়র খনন করান। আজ থেকে প্রায় ৩৪৫ বছর আগে ১৬৭৪-৭৫ সালে বর্ধমানের রাজা ঘনশ্যাম রায়, শ্যামসায়র তৈরি করান। ঘনশ্যামের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র কৃষ্ণরাম ১৬৯০ থেকে ১৬৯৫ সাল ধরে প্রায় ৩৩ একর জমির উপরে তৈরি করান আজকের ‘কৃষ্ণসায়র’। কৃষ্ণরাম রায়ের মৃত্যুর কিছু দিন আগে এই সায়র খোঁড়ার কাজ শেষ হয়। কৃষ্ণরাম রাইয়ের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্রবধূ ব্রজকিশোরীদেবী ১৭০৯ সালে রানিসায়র তৈরি করান। এই সরোবরের দক্ষিণ দিকের ঘাটে শিলালিপিতে সায়রটির খননকাল ও প্রতিষ্ঠাতার নাম খোদিত হয়েছে। এই তিন সায়রের ইতিহাসের সঙ্গে বর্ধমানবাসী পরিচিত। কিন্তু এই তিনটি সায়রের অবস্থা যে দিনে দিনে পরিবেশপ্রেমীদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে তা ক’জনে জানেন? সায়রগুলির দূষণ দ্রুত বাড়ছে বলে অভিযোগ পরিবেশপ্রেমীদের।

Advertisement

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ব্যবহারযোগ্য জলের নানা বিষয়ের সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সম্প্রতি এই সায়রগুলির জল বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়েছে। দেখা গিয়েছে, সেই জল ‘হু’-র নির্ধারিত মাত্রা অতিক্রম করে গিয়েছে। জলের ব্যবহারযোগ্যতা মাপার ক্ষেত্রে বর্ণ ও গন্ধ হল প্রাথমিক গুণ। এই সায়রগুলির জলের বর্ণ বা গন্ধ— দু’টিই নির্ধারিত মাত্রার থেকে অনেক বেশি। এ ছাড়া, জলের অস্বচ্ছতার (টারবিডিটি) সর্বোচ্চ মাত্রা যেখানে ৪ এনটিউ (নেফেলোমেট্রিক টারবিডিটি ইউনিট) হওয়া উচিত, সেখানে কৃষ্ণসায়র বাদে বাকি দু’টি জলাশয়ের জল এই মান অতিক্রম করে গিয়েছে (শ্যামসায়র ৮ এনটিউ, রানিসায়র ১৩ এনটিউ)। রানিসায়রের জলের লবণের মাত্রা ০.৭ পিপিটি, যেখানে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মাত্রা ০.৫ পিপিটি। এই তিনটি জলাশয়ের জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) পরিমাণও সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মাত্রার (৫ মিলিগ্রাম/ লিটার) চেয়ে বেশি।

জলাশয়ের দূষণের কারণ সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে, মানুষের দিকেই আঙুল ওঠে। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের সামনে, শ্যামসায়রের ধার বরাবর প্রায় ৩০-৩৫টি দোকান রয়েছে। পরিবেশপ্রেমীদের একাংশের অভিযোগ, এই সব দোকানের বর্জ্য জল প্রতিদিন শ্যামসায়রে মিশছে। দোকানের খাবারের উচ্ছিষ্টও শ্যামসায়রকে দূষিত করছে। এমনকি, এই সায়রের জল দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স ধুতেও দেখা যায় বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। এতে জলবাহিত রোগের ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি, শ্যামসায়রের চারপাশে যে সব নির্মাণ কাজ চলছে, সেখান থেকেও সিমেন্ট, বালির মতো নানা ইমারতি দ্রব্যের অবশিষ্টাংশ জলে মিশে জলাশয়কে দূষিত করছে।

Advertisement

রানিসায়রের ছবিটিও একই রকম। পরিবেশপ্রেমীদের অভিযোগ, রানিসায়রের চারপাশে যে বাড়িগুলি রয়েছে, সেগুলির নিকাশির জল দিনের পর দিন রানিসায়রে মিশছে। শহরের পরিবেশপ্রেমীদের একাংশের দাবি, এই সায়র দু’টির ধারে দিনের পরে দিন পচনশীল আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। যার জেরে জলে ক্ষতিকর জীবাণুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এমনও অভিযোগ উঠছে যে, সায়রগুলি মাঝেমধ্যেই পরিষ্কার করা হলেও, কিছু দিনের মধ্যেই তা আগের অবস্থায় ফিরে যায়। তাই এ বিষয়ে নিয়মিত নজরদারি একান্ত জরুরি বলেই দাবি পরিবেশকর্মীদের।

কৃষ্ণসায়রের ধারে একটি পার্ক গড়ে উঠেছে। এখানে মানুষের কার্যকলাপ কম হওয়ার কথা। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিজ্ঞতা বলছে, কৃষ্ণসায়র প্রায় সারা বছরই কচুরিপানায় ভরা থাকে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা যাকে ‘ইউট্রিফিকেশন’ বলে থাকেন, কৃষ্ণসায়র তার সবথেকে বড় শিকার। জলাশয়ের জলে ‘ইউট্রিফিকেশন’ বাড়লে তাতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রার তারতম্য ঘটে। কৃষ্ণসায়রেও তা ঘটছে। গত বছর নভেম্বরে কৃষ্ণসায়রের কচুরিপানা পরিষ্কারের সময় কীটনাশক দেওয়ার ফলে জলাশয়ের বেশ কিছু মাছও মারা যায় বলে অভিযোগ। সেই মাছ পচে দুর্গন্ধও তৈরি হয়ে ছিল বলে পরিবেশপ্রেমীরা জানিয়েছেন। কৃষ্ণসায়রের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পরিযায়ী পাখিরা। ফি-বছর শীতকালে কৃষ্ণসায়রে বহু পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে। কিন্তু কৃষ্ণসায়রের জল যে ভাবে দূষিত হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে এই পাখিদের আনাগোনার উপরে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে, বাস্তুতন্ত্রের অন্য দিকটি নিজের অজান্তেই বিপর্যস্ত করে তুলছি না তো? প্রশ্নটা নিয়ে এ বার ভাবার সময় এসেছে।

সবশেষে বলতে হয়, এই তিনটি সায়রের পাশাপাশি, ভাল নেই শহরের বাকি জলাশয়গুলিও। শহরের নানা পুকুরের ধারে দিনের পর পর দিন আবর্জনার স্তূপ জমা হতে থাকে। জলের ব্যবহারযোগ্যতা কমে যাওয়ার ঘটনা নিঃশব্দে ঘটেই চলেছে। আশার কথা দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারে নানা প্রকল্প রয়েছে। প্রশাসনের তরফে সায়রগুলির জন্য সেই সব প্রকল্পগুলির সাহায্য নেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু, তার পরেও শহরবাসীকে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্মে আমাদের আরও বেশি সচেতন হওয়ার প্রয়োজন। শহরের বাস্তুতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এই সব জলাশয়কে বাঁচাতে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।

গিয়াসুদ্দিন সিদ্দিকি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের শিক্ষক, অরিত্র বসাক ওই বিভাগের গবেষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন