Sourced by the ABP
গত কয়েক দশক ধরে দেশ জুড়ে হিন্দুত্ব ঘিরে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের যে চেষ্টা শুরু হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে তার তেমন প্রভাব লক্ষিত হয়নি। বরং এ রাজ্যে ফল হয়েছে উল্টো। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন শাসক দলের পক্ষে অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা-সহ উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রচারের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী ভোটবাক্সে হিন্দু ভোটার একত্র করার চেষ্টা এ রাজ্যে তত কার্যকর না হলেও, সংখ্যালঘু সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে যে কিছু ইন্ধন জুগিয়েছে, সন্দেহ নেই। অভিযোগ, সংখ্যালঘুদের সেই ধর্মীয় একতাকে তুষ্ট করে একের পর এক নির্বাচনে সুফল তুলেছে এই রাজ্যের শাসক দল।
কিন্তু সম্প্রতি মুর্শিদাবাদের রেজিনগরে বাবরি মসজিদের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে শাসক দল থেকে সদ্য বহিষ্কৃত হুমায়ুন কবীর এ বার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধেই হিন্দু তোষণের বিস্ফোরক অভিযোগ করেছেন। জনগণের করের টাকায় দিঘায় জগন্নাথধাম প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে দুর্গাপুজোয় আয়োজকদের মোটা আর্থিক অনুদান, হিন্দুদের নানা ধর্মীয় উৎসবে সরকারি অফিসে দরাজ ছুটি-সহ সরকারের নানা পক্ষপাতমূলক আচরণ নিয়ে সরব তিনি। এক দিকে তা তথাকথিত মুসলমান ধর্মগুরু ও বুদ্ধিজীবীদের একাংশের সমর্থন পেয়েছে, আবার তাঁর মসজিদ নির্মাণ কর্মসূচিতেও বহু মানুষের সমাবেশ ঘটেছে, দানবাক্স ও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে বিপুল অর্থ। নির্মাণসামগ্রীতে ভরে গেছে প্রস্তাবিত মসজিদের মাঠ।
ব্রিগেডেও সম্প্রতি সনাতন সংস্কৃতি সংসদ পাঁচ লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠের যে আয়োজন করেছিল, তাতে বিভিন্ন মঠ ও হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সন্ন্যাসী, আধ্যাত্মিক নেতাদের সঙ্গে বহু সাধারণ মানুষও যোগ দেন। অনেকেই মনে করছেন, পিঠোপিঠি দু’টি ধর্মীয় কর্মসূচি এ রাজ্যে ইসলামি মৌলবাদ ও উগ্র হিন্দুত্ববাদের বহিঃপ্রকাশ। প্রশ্ন, উগ্র হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন ও ইসলামি মৌলবাদের ক্রমবর্ধমান বিস্তার, এই দুইয়ের টানাটানিতে এ রাজ্যেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে কি তবে ফাটল ধরছে? উভয় কর্মকাণ্ডের আয়োজকরা এগুলিকে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক উদ্যোগ বলে দাবি করেছেন, তবে নানা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ও তাঁদের বক্তব্যে রাজনীতির ঝাঁঝে গোপন অভিসন্ধি চাপা থাকেনি।
অনেকে বলছেন, এমনটা হওয়ারই ছিল। রসায়নশাস্ত্রে দ্রবণের প্রকৃত ঘনত্ব নিরূপণের জন্য টাইট্রেশন বা অনুমাপন পরীক্ষা হয়, সেখানে বিক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত দ্রবণে ধীরে ধীরে জানা ঘনত্বের দ্রবণ যোগ করা হয়। বিরোধীদের তোলা সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ ভোঁতা করতে গত কয়েক বছর ধরে রাজ্যের শাসক দল এই পদ্ধতিই অবলম্বন করছে। শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের মতো দায়িত্ব-কর্তব্য মুলতুবি রেখে নানা ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে জনসাধারণের করের টাকা অপচয়ে বিভেদের যে উর্বরভূমি সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে সাম্প্রদায়িকতার ডালপালা মেলা অবশ্যম্ভাবী ছিল।
সামাজিক রসায়নের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যে গবেষণাগারের রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার নিয়মের তোয়াক্কা করে না, মহাত্মা গান্ধী তা অনুধাবন করে ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় লিখেছিলেন, “আই ক্লেম দ্যাট হিউম্যান মাইন্ড অর হিউম্যান সোসাইটি ইজ় নট ডিভাইডেড ইনটু ওয়াটারটাইট কম্পার্টমেন্টস কলড সোশ্যাল, পলিটিক্যাল অ্যান্ড রেলিজিয়াস। অল অ্যাক্ট অ্যান্ড রিঅ্যাক্ট আপন ওয়ান অ্যানাদার।” অযাচিত পক্ষপাতমূলক সুবিধার মাধ্যমে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মেরুকরণের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিজেদের অনুকূলে টানার অপচেষ্টাই বুমেরাং হয়ে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বাড়িয়ে তুলছে কি না, ভবিষ্যতে হয়তো তা আরও স্পষ্ট হবে।
যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থানের ধারা ভারত তথা বাংলার গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য হলেও, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির চর্চাও এখানে নতুন নয়। ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা বাঙালিকে ধর্মের ভিত্তিতে বিচ্ছিন্ন করার যে বীজ বোনা হয়, বাঙালি তার প্রসার রোধে তৎপর ছিল। ১৩১৪ বঙ্গাব্দে পাবনা প্রাদেশিক সম্মিলনীতে সভাপতির অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “কত শত বৎসর হইয়া গেল, আমরা হিন্দু ও মুসলমান একই দেশমাতার দুই জানুর উপরে বসিয়া একই স্নেহ উপভোগ করিয়াছি, তথাপি আজও আমাদের মিলনে বিঘ্ন ঘটিতেছে।” পারস্পরিক মিলনে বিঘ্ন হয়তো বাঙালি কখনওই পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি, কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলায় সুদীর্ঘকাল তা তেমন ডালপালাও মেলতে পারেনি। ভারত সাংবিধানিক ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ, এ দেশে তথা রাজ্যে নিজ নিজ ধর্মের অনুসারীদের উপাসনাগৃহ নির্মাণ স্বাভাবিক ঘটনা। সঙ্গত কারণেই যার যার ধর্মাচরণ বা উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়েও কোনও বিতর্ক বা দ্বন্দ্ব হওয়ার কথা নয়।
বিভেদের সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় প্রসঙ্গে ওই অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “হিন্দু ও মুসলমান, ভারতবর্ষের এই দুই প্রধান ভাগকে এক রাষ্ট্রসম্মিলনের মধ্যে বাঁধিবার জন্য যে ত্যাগ, যে সহিষ্ণুতা, যে সতর্কতা ও আত্মদমন আবশ্যক তাহা আমাদিগকে অবলম্বন করিতে হইবে।” নাগরিকের মঙ্গলে ধর্মীয় বিষয়ে রাষ্ট্রের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মেরুকরণের রাজনীতি বন্ধ হওয়া যেমন প্রয়োজন, তেমনই দরকার প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার অবসান। এই দুই বিষবাষ্পে ভারতের ঐতিহ্যগত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান যাতে বিঘ্নিত না হয়, জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে প্রত্যেকটি দায়িত্বশীল নাগরিকের তা নিয়ে সতর্কতা বাঞ্ছনীয়।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে