Labour law

বিকল্পের সন্ধানও করতে হবে

আরও একটা আপত্তি কিছুটা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। তা হল, এই চারটি বিধি শ্রমিকদের এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, ব্যক্তিসর্বস্ব সত্তা হিসাবে দেখছে।

Advertisement

নরেন্দ্র নাথ আইচ

শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:৫৪
Share:

আলোচনাটা শুরু হয়ে গেল। কৃষকরা পেরেছেন, শ্রমিকরা কি পারবেন না? কৃষক আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার, তা হলে শ্রম বিধিই বা বাতিল করবে না কেন? চুয়াল্লিশটি শ্রম আইন একত্র করে চারটি শ্রমবিধি তৈরি করেছে কেন্দ্র: শিল্প সম্পর্ক, মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা ও শিল্প নিরাপত্তা বিষয়ে। ঘোষিত উদ্দেশ্য উৎপাদন শিল্পে ভারতের উন্নতি, অর্থনৈতিক অগ্রগতি। সংসদে বিধিগুলি পাশ হয়ে গিয়েছে। শ্রমিক সংগঠনগুলি প্রথম থেকেই শ্রম বিধির বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে আসছে। সম্প্রতি কলকাতায় আয়োজিত ‘শ্রমজীবী কনভেনশন’-এ শ্রম বিধি বাতিলের জন্য কৃষক আন্দোলনের ধাঁচে সর্বভারতীয় আন্দোলনের ডাক শোনা গেল। কী নিয়ে চিন্তিত এঁরা? নতুন আইন হলে আট ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করতে হবে, যখন খুশি ছাঁটাই করা যাবে, কাজের জায়গায় স্বাস্থ্য প্রভৃতি নিরাপত্তা মিলবে না, সমান কাজে সমান বেতন পাওয়ার অধিকার থাকবে না। এই নিয়েই উদ্বেগ।

Advertisement

আরও একটা আপত্তি কিছুটা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। তা হল, এই চারটি বিধি শ্রমিকদের এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, ব্যক্তিসর্বস্ব সত্তা হিসাবে দেখছে। শিল্পসম্পর্কের পরিসরকে নিয়ে আসতে চাইছে বিচ্ছিন্ন, ব্যক্তিগত দেনাপাওনার পরিধিতে। শিল্পশ্রমিক এত দিন বেঁচেছে সঙ্ঘবদ্ধতায়। যে যূথবদ্ধতার সংস্কৃতি তাকে এনে দিয়েছিল আট ঘণ্টা কাজ থেকে শুরু করে আরও বহুবিধ অধিকার, নতুন শ্রমবিধির মূল সুর তার বিপ্রতীপ।

কিন্তু শ্রমিকরা তো পারবেন না কৃষকের মতো সীমান্তে বসে থাকতে। কৃষক ছিলেন নিজেই নিজের মালিক, শ্রমিক তা নয়, তাঁর উপর নেমে আসবে ছাঁটাইয়ের খড়্গ। কৃষক আন্দোলন সহায়তা পেয়েছিল ধনী কৃষকদের, শ্রমিকের প্রতিপক্ষ হল বৃহৎ পুঁজি। কৃষকরা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশের সমর্থন পেয়েছিলেন, শ্রমিকের ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা কম। অনেকেই মনে করেন যে, ‘অতিরিক্ত গণতন্ত্র’ বা শ্রমিকের অধিকারের আইনি সুরক্ষা বস্তুত দ্রুত অগ্রগতির পথে বাধা।

Advertisement

কৃষক আন্দোলন সফল হয়েছে, কিন্তু কোনও বিকল্প সংস্কারের দিশা দেখায়নি। জয় হয়েছে স্থিতাবস্থার। শ্রমিকের ক্ষেত্রটা অন্য রকম। আইনকে পাশ কাটিয়ে শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন সহজ, তাই শুধু বর্জন নয়, এক বিকল্প দিশা দেখানোটাও আজ শ্রমিক আন্দোলনের দায়িত্ব। শুধু নিজেদের স্বার্থেই নয়, আন্দোলন যাতে একটা নিজস্ব নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠতে পারে, তার জন্যও এটা জরুরি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিক সমাজ থেকে অনেক প্রস্তাব আসে, যা হয়ে দাঁড়াতে পারে সরকারের জন্য দিকনির্দেশিকা। শ্রম সংস্কারের বিষয়ে এই রকম একটি সুচিন্তিত প্রস্তাব তৈরি করেছে শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল থিয়োরি’ (সি-প্যাক্ট)। ‘রিথিঙ্কিং দি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউটস অ্যাক্ট’ প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব আছে। যেমন, এক, ভারতে শ্রম আইন অনুসারে, শিল্প প্রতিষ্ঠানে অন্তত দশ বা কুড়ি জন কর্মরত শ্রমিক না থাকলে তা আইনের সুরক্ষার আওতায় আসে না। এই কারণেই স্থায়ী কর্মী কমিয়ে ঠিকা কর্মীদের দিয়ে কাজ চালাতে চায় অনেক মহল। এই অচলাবস্থা কাটাতে প্রস্তাব, সংস্থায় যত জনই কর্মী থাকুন, আর তাঁরা যত দিনই কাজ করুন, সবাইকেই স্থায়ী শ্রমিক হিসাবে গণ্য করতে হবে। তা হলে প্রত্যেক শ্রমিক পিএফ, বোনাস, গ্র্যাচুইটির সুবিধাগুলো পাবেন। ছাঁটাই হলে কী ভাবে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নির্ধারিত হবে, তা-ও নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। দুই, কোনও কারখানায় মোট শ্রমিকের পাঁচ শতাংশের বেশি ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে না, যেখানে শ্রমিক কুড়ি জনের কম, সেখানে এটা সর্বোচ্চ কুড়ি শতাংশ হতে পারে। আরও বলা হয়েছে, ঠিকা শ্রমিককে কোনও একটি ঠিকাদার সংস্থার কর্মী হতে হবে। তাঁরা সেই সংস্থার স্থায়ী শ্রমিক হিসাবে বেতন-সহ অন্য সুবিধাগুলো পাবেন। যে কাজে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ হচ্ছে, ঠিকাদার সংস্থাকে সেই ক্ষেত্রেরই হতে হবে। এটা হলে ভুয়া ঠিকা ব্যবস্থা, এবং ঠিকাদারের দ্বারা শ্রমিকের প্রতারণার অবসান ঘটতে পারে। তিন, প্রতি কারখানা বা সংস্থায় গোপন ব্যালটের মাধ্যমে কারখানার কর্মীদের মধ্যে থেকে শ্রমিক কাউন্সিল তৈরি হবে, কোনও বহিরাগতের ঠাঁই হবে না। এতে রাজনৈতিক স্বার্থে শিল্পক্ষেত্রে অশান্তি কমবে।

চার, ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউটস অ্যাক্ট’ আইনে বিরোধ নিষ্পত্তি সময়সাপেক্ষ। তাই কোনও বিরোধ হলে শ্রমিক কাউন্সিল তা মেটাতে চেষ্টা করবে। ব্যর্থ হলে কাউন্সিল ও ম্যানেজমেন্ট-এর প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি গঠিত হবে। তার পর যাবে ট্রাইবুনালে।

ভারতে শিল্পে ব্যর্থতার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী সময়োপযোগী প্রযুক্তি গ্রহণের অভাব, প্রশিক্ষণের নিম্নমান বা ত্রুটিপূর্ণ বিপণন কৌশল। শ্রমিকের দোষ সামান্যই, অথচ সংস্কারের মোড়কে যাবতীয় অবনমন আর অবদমন শ্রমিকের উপর দিয়েই গিয়েছে। সেই ভুলের সংশোধনের প্রয়াস এখনও নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন