হাত দুটো দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল প্রায় আধঘণ্টা। ক্রমাগত চাপ দেওয়া হচ্ছিল, যাতে তিনি স্বীকার করেন, তিনি বাংলাদেশি। এমনই অভিযোগ করেছেন নদিয়ার চাপড়ার আনাজ শেখ, হরিয়ানা পুলিশের বিরুদ্ধে। জুলাই মাস জুড়ে নানা খবরে প্রকাশ পেয়েছে এমন অনেকগুলি ঘটনা। নদিয়া জেলার জনা ত্রিশেক পরিযায়ী শ্রমিককে আটক করেছিল হরিয়ানার পুলিশ। ওড়িশায় আটক করা হল নদিয়া ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার কিছু শ্রমিককে, নাগরিকত্বের বৈধ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মুর্শিদাবাদের পরিযায়ী শ্রমিকদের জোর করে বাংলাদেশে ছেড়ে এল মহারাষ্ট্রের পুলিশ। দিল্লির ‘জয় হিন্দ কলোনি’-র কয়েকশো বাংলাভাষী বাসিন্দাকে জোর করে উচ্ছেদ করা হল।
সংবিধানের ১৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, নাগরিকের অধিকার রয়েছে ভারতের যে কোনও অংশে অবাধে ভ্রমণ করা, বসবাস করার। অনুচ্ছেদ ১৫ বলছে, জন্মস্থানের ভিত্তিতে কোনও রকম বৈষম্য করে যাবে না। অনুচ্ছেদ ১৬ বলছে, জন্মস্থান বা বাসস্থান কখনওই নাগরিক অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হবে না। তা হলে কেন পরিযায়ী শ্রমিকদের আধার কার্ড, ভোটার কার্ডের মতো স্বীকৃত পরিচয়পত্র থাকলেও আটক করা হচ্ছে? এ কেবল বেআইনি কাজ নয়, এটা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।
দেশে মোট শ্রমিকের প্রায় ৩০ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিক। নীতি আয়োগ স্পষ্ট জানিয়েছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের শ্রমকে যথাযথ স্বীকৃতি দিতে হবে। নয়তো উন্নয়ন, শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথচ যখন একাধিক রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি শ্রমিকদের নিগ্রহ ঘটছে, তখন কেন্দ্রীয় সরকার নীরব দর্শক। কোভিড অতিমারির সময়ে কেন্দ্রের ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’-এর নীতিতে পরিযায়ী শ্রমিকের স্বীকৃতি ছিল। আজ রেশন কার্ড শ্রমিকের খাদ্য নিরাপত্তা দূরে থাক, দেহের নিরাপত্তাও দিতে পারছে না।
ভিন রাজ্যে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রধান দু’টি আইন ‘রেগুলেশন অব এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড কন্ডিশনস অব সার্ভিস অ্যাক্ট, ১৯৭৯’ এবং ‘ইন্টার-স্টেট মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কমেন অ্যাক্ট, ১৯৭৯’। দ্বিতীয় আইনটিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের রক্ষাকবচগুলির কথা বলা আছে। একই ধরনের কাজে স্থানীয় শ্রমিকদের সমান বা বেশি মজুরি পেতে পারেন পরিযায়ী শ্রমিক, কিন্তু কম পেতে পারেন না। স্থানচ্যুতি ভাতা, বাড়িতে যাওয়ার ভাতা, থাকার জায়গা, নিখরচায় চিকিৎসার নির্দেশ রয়েছে। শ্রমিক-জোগানো ঠিকাদারের নথিভুক্তি, নিয়োগকর্তার ভূমিকা, সবই আইনে বলা রয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারও ‘বাঙালি অস্মিতা’-র কথা তুলে ছাড় পেতে পারে না। এই নিগৃহীত পরিযায়ী শ্রমিকরা যাদের ব্যবস্থাপনায় অন্য রাজ্যে কাজ পেয়েছিলেন, এমন ঠিকাদার বা মূল নিয়োগকারীর বিরুদ্ধে কি রাজ্য সরকার আইনি ব্যবস্থা করেছে? পরিযায়ী শ্রমিকরা চেনাজানা যোগাযোগ বা ‘নেটওয়ার্ক’-এর মাধ্যমেই অন্যত্র যান। প্লেসমেন্ট এজেন্সি বা ঠিকাদারদের মধ্যস্থতা ছাড়া কেউ অন্য রাজ্যে কাজের খবর পান না। এঁরা কোথায় ছিলেন মজুর-নিগ্রহের সময়ে? তাঁদের কর্তব্যচ্যুতির জন্য কী ব্যবস্থা করছে সরকার?
এমন নয় যে সরকারের কাছে মধ্যস্থতাকারী এজেন্সির তথ্য নেই। পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ তৈরি করেছে। এখনও অবধি পরিযায়ী শ্রমিক নথিবদ্ধ হয়েছেন ২১ লাখ ৬৭ হাজার। পরিযায়ী শ্রমিককে ‘সেলফ সার্টিফিকেট’-এর পাশাপাশি যে রাজ্যে বা জেলায় কাজ করতে যাচ্ছেন, সেখানকার নির্দিষ্ট সরকারি এজেন্সির একটি সার্টিফিকেট আপলোড করতে হবে। না হলে রেজিস্ট্রেশন অসম্পূর্ণ থাকে। অতএব এই মধ্যস্থতাকারী ঠিকাদার, এজেন্সির খবর রাজ্য সরকারের রয়েছে।
পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে শাসক ও বিরোধী, উভয়ই রাজনীতি করছেন, করুন। কিন্তু “ঘরে ফিরে আয়” বলে ডাক দিলেই পরিযায়ী শ্রমিকরা রাজ্যে ফিরে আসবেন না। বরং দেখা দরকার, তাঁরা অন্য রাজ্যে গিয়েছিলেন কেন? বাস্তব এই যে, এ রাজ্যে মজুরি কম। রাজ্যের আশিটি পেশায় সরকার নির্ধারিত মজুরিটুকুও এই রাজ্যের শ্রমিকরা পান না। তাই এত অত্যাচার সহ্য করেও রাজ্যে ফিরতে চান না। অন্য রাজ্যে তাঁরা তিনগুণ বা তারও বেশি টাকা দিনমজুরি পাচ্ছেন। কেবল রাজ্য সরকারের প্রকল্পের কাজ, বা সরকারি অনুদানের আশায় তাঁরা ফিরবেন না। রাজ্য সরকার ছ’মাস অন্তর ন্যূনতম মজুরির সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ করছে। আজ পরিযায়ী শ্রমিকদের ঝুঁকি নিয়ে কথা হচ্ছে, কিন্তু সুবিধাগুলো ভুললে চলবে না। কেরলে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকরা প্রত্যেকে সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে বাসস্থান, নিখরচায় চিকিৎসা পান, মজুরি তো বেশি বটেই।
নিরাপদ থাকতে হলে রাজ্যে ফিরতে হবে, এটা সরকারের বার্তা হতে পারে না। সরকারের কর্তব্য, যে কোনও রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। শুধু কল্যাণ পর্ষদ তৈরি করে আহত-নিহতদের ভাতা দিলেই হবে না। তাদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকারকে একটি নির্দিষ্ট বিভাগ গঠন করতে হবে। পাশাপাশি, ভাবতে হবে, পশ্চিমবঙ্গ কি কেবলই সস্তার মজুর দিয়ে পুঁজিপতিদের আকর্ষণ করবে? না কি উন্নত মানব সম্পদ জোগানোর প্রতিশ্রুতি দেবে, এবং উপযুক্ত পারিশ্রমিক নিশ্চিত করবে?
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে