Narendra Modi

২০৪৭ সালে দেশকে ‘উন্নত’ দেখতে চায় মোদী সরকার, ভারত কি সেই লক্ষ্যপূরণ করতে পারবে?

‘উন্নয়নশীল’ থেকে ‘উন্নত’ দেশ হয়ে উঠতে গেলে কী কী শর্ত পূরণ করতে হতে পারে ভারতকে? বিষয়টা সোনার হরিণের পিছনে দৌড়নো হয়ে যাচ্ছে না তো?

Advertisement

টি এন নাইনান

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০২৩ ১১:১৯
Share:

উন্নয়নের চূড়ায় ওঠার জন্য যদি ভারত চেষ্টা চালিয়েও যায়, তবে বলতে হবে, সেই চূড়াটিতে ইতিমধ্যেই ভিড় জমতে শুরু করেছে। প্রতীকী চিত্র।

নরেন্দ্র মোদী সরকার দেশের সামনে একটি লক্ষ্য রেখেছে। ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতকে ‘উন্নয়নশীল’ দেশ থেকে ‘উন্নত’ দেশে পরিণত হতে হবে। প্রাথমিক ভাবে এটা এক অবাস্তব হুকুম বলে মনে হতে পারে। কেউ এর মধ্যে কিছু সোনার হরিণ মার্কা অঙ্গীকারও দেখতে পারেন। ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা বা শিল্পোৎপাদনকে মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি-র ২৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া অথবা আগামী বছরের মধ্যে ভারতকে ৫ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলারের অর্থনীতির দেশে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি এই সব ‘সোনার হরিণ’-এর মধ্যে অন্যতম। সেই সঙ্গে এ-ও মনে রাখা দরকার যে, ‘উন্নত দেশ’ বলতে ঠিক কী বোঝানো হচ্ছে, সেই সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট সংজ্ঞা সরকার দেয়নি। আবার এমন কোনও আন্তর্জাতিক মাপকাঠিও নেই, যার দ্বারা ‘উন্নত’ শব্দটির মানে বোঝা যাবে।

Advertisement

উন্নয়নের বিভিন্ন রকম সূচক রয়েছে। সেই সূচকগুলির কোনওটি আয়স্তরের কথা বলে, কোনওটি স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার মান নিয়ে আলোচনা করে, কোনওটি আবার জীবনযাত্রার মান (বিদ্যুৎ বা নিরাপদ পানীয় জলের পরিষেবার ন্যূনতম নিরিখে)-এর দিকে ইঙ্গিত করে।কর্মসংস্থানের সুযোগ, দারিদ্ররেখা, অসাম্য, প্রযুক্তিগত অবস্থান ইত্যাদিও উন্নয়নের বিবিধ সূচক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এই সব সূচকের নিরিখে দেখলে মনে হতেই পারে যে, ভারত অনেক ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত বিন্দুগুলি ছুঁতে পারছে না। সে দিক থেকে ভাবলে আগামী ২৫ বছরে এমন এক লক্ষ্য স্থির করে রাখা একটু বাড়াবাড়ি রকমের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন জীবনের কথা কি ভাবা যায়? ১৯৪৭ থেকে ২০৪৭— এই একশো বছরে এই লক্ষ্যে পৌঁছনো সত্যিই দুঃসাধ্য।বিশেষত উন্নয়নের গতির কথা মাথায় রেখে ভাবতে বসলে তো বটেই।

যদি ভারত এই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে? তা হলে একেবারে গোড়ায় আগামী ২৪ বছরের মধ্যে এ দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় পাঁচ গুণেরও বেশি বাড়াতে হবে। সেই কাজটি করতে হলে অর্থনীতির বার্ষিক বৃদ্ধির হার অন্তত ৭ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন। যে সময় থেকে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হিসাব রাখা শুরু হবে, সেই মুহূর্ত থেকেই খেয়াল রাখতে হবে যেন জিডিপি-র বৃদ্ধি তার থেকে দ্রুতগতির হয়। এই গতির বিষয়টি কয়েকটি ছোট ক্ষেত্র বাদ দিলে এখনও পর্যন্ত অধরাই থেকে গিয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে খুব কম দেশই এমন দ্রুতগতির বৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে। ভারতের ক্ষেত্রে সেই মাত্রা স্পর্শ করার সময় এখনও দূর অস্ত। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট কথায় বলতে গেলে, ভারত ২০৪৭ সালে সেই কাঙ্ক্ষিত ‘উচ্চ আয়’-এর গণ্ডি ডিঙোতে পারবে না।

Advertisement

বরং ‘খুব উঁচু দরের’ মানবিক উন্নয়নের লক্ষ্যপূরণ কিছুটা সহজ হতে পারে। গত ২৫ বছরে মানবোন্নয়নের সারণিতে ভারত বেশ উন্নতি করেছে, এ কথা মনে রাখতে হবে। উন্নয়নের সেই হার বজায় রাখা গেলে ২০৪৭ নাগাদ ওই সারণিতে ভারত সাম্প্রতিক অবস্থান ০.৬৩৩ থেকে ‘অত্যুচ্চ’ পর্যায় বা ০.৮০০-এ পৌঁছতে পারবে।

এ বার অন্য এক মাপকাঠির দিকে তাকানো যাক। কোনও দেশের শিল্পোৎপাদিত পণ্যের রফতানির মধ্যে উচ্চমানের প্রযুক্তির জিনিসপত্রের অংশ বিচার করতে বসলে দেখা যাবে, ভারতের ক্ষেত্রে তা ১০ শতাংশ। পরিসংখ্যানটি ব্রাজিল বা রাশিয়ার সমান। বিশ্বে এর গড় ২০ শতাংশ। চিনের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে মাত্র ১ শতাংশ! গবেষণাজাত বিষয়ের দিক থেকে দেখলে সামগ্রিক ভাবে ভারতের গতি বেশ দ্রুত। পরিমাণগত দিক থেকে ভারত বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। চিন যে পরিসংখ্যান প্রকাশ্যে আনে, তা অবশ্য ভারতের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। তাই উন্নয়নের চাকা যত দ্রুতই গড়াক, ‘উন্নত দেশ’-এর মাপকাঠি টপকানোর বিষয়টা এখনও ধোঁয়াশা।

দারিদ্র সংক্রান্ত পরিসংখ্যান থেকেও এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভারতদর্শন সম্ভব। যে সময় ভারত এক নিম্ন আয়ের দেশ ছিল, তখন ২.১৫ আমেরিকান ডলারের মাথাপিছু দৈনিক আয়ের মাপকাঠি এ দেশকে ‘চূড়ান্ত দরিদ্র’ বলে দাগিয়ে দিতে পেরেছিল। কিন্তুএখন নিম্ন-মধ্য আয়ের গণ্ডি এ দেশ স্পর্শ করেছে। এখন আর সেই পুরনো তকমা দেওয়া সম্ভব নয়। নিম্ন-মধ্য আয়ের মাপকাঠিটি হল দৈনিক মাথাপিছু ৩.৬৫ আমেরিকান ডলার আয় (ভারতীয় মুদ্রায় প্রতিদিন ৯০ টাকা, ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে চার জনের পরিবারে মাসে ১০,৮০০ টাকা)। সেই নিরিখে দেখলেও লক্ষ কোটি ভারতীয় এখনও গরিব। উচ্চ-মধ্য আয়ের মাপকাঠিটি পেরোতে হলে ভারতকে বেশ খানিকটা উপরে উঠতে হবে। দৈনিক মাথা পিছু আয় ৬.৮৫ আমেরিকান ডলারে নিয়ে যেতে হবে।

মনে রাখা দরকার, ২০৪৭ সালে যদি ভারত ‘উন্নত দেশ’-এর মর্যাদাপ্রাপ্তও হয়, তবু তাকে কোনও অনন্য উদাহরণ বলা যাবে না। ইতিমধ্যেই ৮০টিরও বেশি রাষ্ট্রকে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ‘উচ্চ আয়ের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যেখানে ভারতের গায়ে লেগে রয়েছে নিম্ন-মধ্য আয়ের ছাপ্পা। রাষ্ট্রপুঞ্জের ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ৬৫টিরও বেশি দেশকে মানবিক উন্নয়নের ‘অতি উচ্চ’ পর্যায়ে রয়েছে বলে চিহ্নিত করেছে। সেখানে ভারত রয়েছে ‘মাঝারি’ স্তরে। ‘উচ্চ’ স্তরের ধারেকাছেও ভারত এখনও পৌঁছতে পারেনি। যাকে বহুমাত্রিক দারিদ্র বলা হয়, তার দূরীকরণের ব্যাপারে ভারত যথেষ্টই পিছিয়ে।

উন্নয়নের চূড়ায় ওঠার জন্য যদি ভারত চেষ্টা চালিয়েও যায়, তবে বলতে হবে, সেই চূড়াটিতে ইতিমধ্যেই ভিড় জমতে শুরু করেছে। ২০৪৭-এ যদি ভারত সেখানে পৌঁছয়, তা হলেও বলতে হবে যে, বড় দেরি হয়ে গিয়েছে। বাস্তবের এই ছবিবুঝতে পারলে ভারত তার অন্তঃসারশূন্য গর্ব থেকে বেরিয়েও আসতে পারবে। গত তিন দশকের রেকর্ড অবশ্যই উল্লেখযোগ্য রকমের ভাল। তবু ওই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে এখনও প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু এই যাত্রার সময় যদি আবার নতুন এক সোনার হরিণকে লক্ষ্য হিসাবে স্থির করে দেওয়া হয়, তা হলে কিন্তু মুশকিল আছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন