Diarrhea

এ লজ্জা ব্যক্তির, সমাজেরও

গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বার বার ডায়রিয়া হলে, বিশেষ করে বাচ্চাদের, খাদ্যের সারাংশ শোষণ করে পুষ্টি-বৃদ্ধির ক্ষমতা হ্রাস পায়।

Advertisement

অরবিন্দ ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৬:০৯
Share:

ভারতের ক্ষেত্রে এই হার ৬.৫ শতাংশ।

বিশ্ব জুড়ে ডায়রিয়া বা উদরাময় এখনও শিশুমৃত্যুর একটি বড় কারণ। ইউনিসেফ-এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট শিশুমৃত্যুর প্রায় ৮ শতাংশের কারণ হল ডায়রিয়া। ভারতের ক্ষেত্রে এই হার ৬.৫ শতাংশ। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বার বার ডায়রিয়া হলে, বিশেষ করে বাচ্চাদের, খাদ্যের সারাংশ শোষণ করে পুষ্টি-বৃদ্ধির ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে, বুদ্ধি, বৃদ্ধি ও শারীরিক বিকাশ ব্যাহত হয়।

Advertisement

বিভিন্ন গবেষণায় এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, উন্মুক্ত স্থানে শৌচকর্ম ডায়রিয়া ছড়ানোর একটি অন্যতম কারণ। স্বাস্থ্যের দিক ছাড়া সামাজিক কারণেও এটি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। বাড়ির মধ্যে শৌচাগারের ব্যবস্থা থাকলে, বিশেষ করে মেয়েরা অনেক বেশি সুরক্ষিত থাকতে পারবেন। এ সব কথা ভেবেই ১৯৮৬ সালে ভারতে সেন্ট্রাল রুরাল স্যানিটেশন প্রোগ্রাম (সিআরএসপি) চালু হয়। এই প্রকল্পটি ভারতে উন্মুক্ত স্থানে শৌচকর্ম বন্ধ করার লক্ষ্যে প্রথম একটি কাঠামোবদ্ধ, সুসংহত প্রয়াস। উদ্দেশ্য ছিল, ২০১০ সালের মধ্যে এই কুঅভ্যাস পুরোপুরি বন্ধ করা। কিন্তু ১৯৯০-এর দশক জুড়ে সিআরএসপি-র হতাশাজনক ফল দেখে ১৯৯৯ সালে টোটাল স্যানিটেশন ক্যাম্পেন (টিএসসি) পদ্ধতিটি গৃহীত হয়। এত দিন পর্যন্ত স্যানিটেশন প্রোগ্রাম ছিল উচ্চ ভর্তুকি-নির্ভর। এটা পরিত্যাগ করে, প্রকল্পটিকে চাহিদাচালিত করার জন্য পদক্ষেপ করা হল। ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকার ও রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্যোগে আর জেলা পরিষদের সহায়তায় মেদিনীপুর জেলায় এ-কাজে বিশেষ অগ্রগতি ছাড়া তেমন কোনও সাড়া জাগানো পদক্ষেপ মানুষের স্মৃতিতে নেই। যদিও অক্টোবর, ২০০৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার স্যানিটেশনের কাজে উৎসাহ দেওয়ার জন্য নির্মল পুরস্কার ঘোষণা করে। উদ্দেশ্য, ২০১২ সালের মধ্যে ভারতের সমস্ত গ্রামের মানুষের শৌচাগার ব্যবহারের সুযোগ নিশ্চিত করা।

বিষয়টি নিয়ে এত গভীরে কখনও চিন্তা করার সুযোগ ঘটেনি। সুযোগ এল ২০১০ সালে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া, বার্কলের অর্থনীতির অধ্যাপক প্রণব বর্ধন তাঁর সদ্য প্রকাশিত অ্যাওয়েকেনিং জায়ান্টস: ফিট অব ক্লে বইটির উপরে এক আলোচনা চক্রে সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করে জানালেন, সামাজিক উন্নয়নের বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভারতের থেকে তো বটেই, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের থেকেও বাংলাদেশ এখন অনেকটাই এগিয়ে। প্রসঙ্গত, অধ্যাপক বর্ধন বাংলাদেশে উন্মুক্ত স্থানে শৌচকর্ম বন্ধের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির কথাও বলেন।

Advertisement

ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় জনগণনা ২০১১ প্রকাশ পাওয়ার পরে দেখা গেল, ভারতে যেখানে শৌচাগারবিহীন পরিবার ৫৩.১ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গে ৪১.২ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ৭ শতাংশ। বাংলাদেশের এই সাফল্যের একটি বড় কারণ হল— তাঁরা মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, বাড়িতে শৌচাগার না থাকা একটি সামাজিক ও ব্যক্তিগত লজ্জা। কাপড় না পরে বেরোনো যেমন লজ্জার, বাড়িতে শৌচাগার না থাকাটাও তেমনই।

এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে শিশুদের বৃদ্ধি ও বুদ্ধি বিকাশে শৌচাগার ব্যবহারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা উল্লেখ করে গবেষণাপত্র দেশ-বিদেশে প্রকাশিত হতে শুরু করে। ২০১৪ সালে ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি-র একটি গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হল, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সম আয়ের পরিবারের শিশুদের (৫ বৎসর বয়স পর্যন্ত) উচ্চতা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের শিশুরা তুলনামূলক ভাবে বেশি লম্বা। উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগের ফলে প্রতিনিয়ত নানান ধরনের ক্ষতিকারক জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে খাদ্য শোষণ ও পুষ্টি বৃদ্ধির ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। বিষয়টি জেনে বহুচর্চিত একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলাম। অনেক পরিবারেই এই প্রজন্মের সন্তানরা আগের প্রজন্মের থেকে অনেকটাই বেশি লম্বা। বোঝা গেল, আগের প্রজন্মের অনেকেরই জিনগত কারণে যতটা বৃদ্ধি ঘটার কথা ছিল, শৌচাগারহীন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও অপুষ্টির জন্য তা ঘটেনি।

আমাদের দেশে নতুন উদ্যমে এই লজ্জাজনক ও অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি নিরসনে স্বচ্ছ ভারত মিশন প্রকল্প ২ অক্টোবর, ২০১৪ সালে চালু হয়। সম্প্রতি ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-৫ (২০১৯-২১)-এর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। দেখা গিয়েছে, এই সমীক্ষার সময়কালে ভারতে উন্মুক্ত স্থানে শৌচকর্মের হার ২০১১ সালের ৫৩.১ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১৯.৪ শতাংশ। তবে রাজ্যগুলির মধ্যে বৈষম্য এখনও যথেষ্ট। এই হার সবচেয়ে বেশি বিহারে (৩৮.৯ শতাংশ), এর পর ছত্তীসগঢ় (৩৩.৯ শতাংশ)। সবচেয়ে কম কেরলে (০.৩ শতাংশ)।

পশ্চিমবঙ্গে এই হার ১২ শতাংশ। তবে জেলাগুলির মধ্যে বিস্তর ফারাক। ভারতের ৭০৭টি জেলার মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা প্রথম চারটি জেলার মধ্যে পুরুলিয়া একটি। অর্থাৎ, এ বারও পশ্চিমবঙ্গ খোলা জায়গায় শৌচকর্ম মুক্ত রাজ্য হয়ে উঠতে পারল না। আরও কিছু কাল হয়তো এই লজ্জাকে আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন