Social Development Work

আটকে যাচ্ছে উন্নয়নও

সরকারি ওয়েবসাইট অনুসারে, কুড়ি হাজারেরও বেশি সংস্থার বিদেশি অনুদান গ্রহণের অনুমোদন (এফসিআরএ সার্টিফিকেট) পুনর্নবীকরণের আবেদন বাতিল হয়েছে।

Advertisement

আশিস রায়

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:৩৩
Share:

—প্রতীকী ছবি।

দাসত্বের পরিস্থিতিতে কাজ করেন যে শ্রমিকরা, তাঁদের মুক্তির জন্য কাজ করেন এক তরুণী। তিনি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ভারতীয় শাখার কর্মী। এখন কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন। শ্রমিকের দাসত্ব নিরসন হয়নি, কমেছে উদ্ধারের কাজে টাকার জোগান। বাতিল হয়েছে তাঁর সংস্থার বিদেশি মুদ্রা গ্রহণের অনুমোদন। ‘ফরেন কন্ট্রিবিউশন (রেগুলেশন) অ্যাক্ট, ২০১০’ অনুসারে যা বাধ্যতামূলক। বিদেশি অর্থ গ্রহণের উপর নজরদারি সত্তরের দশক থেকেই ছিল। তবে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের মেয়াদকালে তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে, ভারতের অসরকারি বা ‘এনজিও’ ক্ষেত্র অস্তিত্বের সঙ্কটে।

Advertisement

সরকারি ওয়েবসাইট অনুসারে, কুড়ি হাজারেরও বেশি সংস্থার বিদেশি অনুদান গ্রহণের অনুমোদন (এফসিআরএ সার্টিফিকেট) পুনর্নবীকরণের আবেদন বাতিল হয়েছে। আরও তেরো হাজার সংস্থার অনুমোদনের মেয়াদ পেরিয়ে গিয়েছে। বর্তমানে ষোলো হাজারের কিছু বেশি সংস্থার অনুমোদন বৈধ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে বিদেশি অনুদান পায় ১০৮৯ সংস্থা, অনুমোদন হারিয়েছে ৩১০৭টি সংস্থা, অর্থাৎ প্রায় তিন গুণ।

বিদেশি অর্থ গ্রহণের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দফতরের নজরদারি থাকবে, সেটাই প্রত্যাশিত। ১৯৭৬ সালে যখন ভারতে জরুরি অবস্থা চলছিল, তখন এ বিষয়ে প্রথম আইন তৈরি হয়েছিল। তা অনেকটাই এই আশঙ্কা থেকে যে, বিদেশি কোনও শক্তি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ না পায়; অসরকারি, স্বনিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলির মাধ্যমে দেশবিরোধী কাজের সুযোগ তৈরি করতে না পারে। বর্তমান আইন অনুসারে, কোনও ভারতীয় ব্যক্তি বিদেশ থেকে সর্বোচ্চ দশ লক্ষ টাকা পেতে পারেন, কোনও কারণ না দর্শিয়ে। তবে সংস্থার ক্ষেত্রে বিদেশি অর্থ গ্রহণের কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। সংস্থার প্রস্তাবিত প্রকল্প, কাজের পরিধি, এ সবের উপরে অনুদান প্রাপ্তির সীমা নির্ভর করে।

Advertisement

২০২১-২২ অর্থবর্ষে আমাদের দেশের অসরকারি সংস্থাগুলি বাইশ হাজার কোটি টাকা বিদেশি অনুদান পেয়েছে। ভারতের মতো জনবহুল দেশে এই অঙ্ক খুব বেশি নয়। ভারতে ৩ লক্ষ ৬৭ হাজারেরও বেশি অসরকারি সংস্থা নিয়মিত বাৎসরিক রিটার্ন জমা দেয়। এর মধ্যে মাত্র ষোলো হাজার সংস্থা বিদেশি অর্থ পাচ্ছে, এই চিত্র খুব উজ্জ্বল নয়। অভিযোগ উঠেছে, আর্থিক বিধিপালনের তুলনায় প্রাধান্য পেয়েছে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা। যে সব সংস্থা ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের বিষয়গুলি সামনে এনেছে, সরকারি নীতির সমালোচনা করেছে, সেগুলির উপরে এফসিআরএ লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে সরকার, শুরু করেছে তদন্ত।

এ কথা ঠিক যে, অনেক এনজিও নিয়ম মেনে কাজ করে না, কর্তাব্যক্তিরা অযোগ্য মানুষকে সুবিধা পাইয়ে দেন, নিজেরাও সুবিধা নেন। কিন্তু বৈষম্য ও দারিদ্রমুক্ত সমাজ গঠনে, উন্নত মূল্যবোধ তৈরিতে, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারে, সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারা বহনে অসরকারি ক্ষেত্রের ভূমিকা কম নয়। তা ছাড়া, বিশ্বায়িত অর্থনীতির সুবিধা যদি কর্পোরেট সংস্থাগুলি পেতে পারে, অবাণিজ্যিক অসরকারি সংস্থাই বা পাবে না কেন?

ব্যাপক হারে অনুমোদন বাতিলের ফলে বিভিন্ন রাজ্যে নানা ধরনের সামাজিক উন্নয়নের কাজ আপাতত বন্ধ। অনেক সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ব্যবহারেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজ্যের প্রান্তিক মানুষ নানা রকম উন্নয়নমূলক পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নারীপাচার বা শিশুশ্রম প্রতিরোধের কাজে অর্থ বন্ধ হলে কত জীবন বিপন্ন হয়, তার পরিমাপ সম্ভব নয়। পাশাপাশি, তীব্র হচ্ছে কর্মহীনতা। বিদেশি অনুদান বন্ধ হওয়ায় ভারতে কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন, তার পরিসংখ্যান না সরকারের কাছে আছে, না এই সংস্থাগুলির কাছে। এদের অনেকেই গ্রামের বাসিন্দা, যাঁরা সামান্য মাসিক বেতনে কাজ করতেন। আবার অনেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে অসরকারি ক্ষেত্রে কাজে এসেছিলেন।

যে অসরকারি সংস্থাগুলির এফসিআরএ সার্টিফিকেট বাতিল হয়েছে, তার কর্তাব্যক্তিরা সম্মিলিত ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাজে প্রতিবাদ করছেন, এমনও দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত এঁদের একাংশ আয়-ব্যয়ের হিসাবে তদন্ত চান না। কোন উদ্দেশ্যে গৃহীত অনুদান প্রকৃতপক্ষে কিসে ব্যয় হয়েছে, সে বিষয়ে অনুসন্ধান তাঁদের বিপদে ফেলতে পারে। আরও একটা কারণ, প্রতিবাদের রাস্তা ধরলে ‘ব্ল্যাক লিস্ট’-এ নাম উঠবে, কোনও দিনই এই অনুমোদন পাবেন না, এই আশঙ্কায় তাঁরা চুপ করে থাকাই ভাল মনে করছেন। আক্ষেপ এই যে, অনেক কর্তাব্যক্তি নিজের সুযোগ-সুবিধাগুলি অক্ষত রেখে ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাই করছেন। এ রাজ্যেই একটি সংস্থা প্রায় সাতশো কর্মীকে বরখাস্ত করেছে, অফিসারদের কিন্তু মাইনে কমেনি।

বহু প্রবাসী ভারতীয় এবং বিদেশি নাগরিক বিপন্ন মানুষের জন্য অসরকারি সংস্থাকে সাহায্য করেন। তাঁদের দান যেন বিফলে না যায়, আর্থিক বেনিয়ম না হয়, তা অবশ্যই দেখতে হবে সরকারকে। কিন্তু অনুমোদন বাতিল করা তার রাস্তা নয়। নিয়মিত নজরদারি করেও অসরকারি ক্ষেত্রকে স্বচ্ছ ও বিধিসম্মত করা যায়। জনকল্যাণের জন্য বহু ধরনের চেষ্টা ও উদ্যোগের প্রয়োজন, তাতে নানা মানুষের সংযুক্তি দরকার। কেবল দেশের মানুষের অর্থসাহায্যে তার কতটুকু সম্ভব?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন