বিজেপির পক্ষে বেশি আসনে জয়ের অঙ্কটা মোটেই কঠিন নয়
Lok Sabha Election 2024

‘পাখির চোখ’ যখন লক্ষ্য

বিজেপি ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে কতগুলি আসন পেয়েছিল? ৩০৩টি। ৫৪৩ আসনের মধ্যে বিজেপি গত লোকসভা ভোটে ৪৩৬টি কেন্দ্রে লড়েছিল। বিজেপি ১৩৩টি আসনে হেরে গিয়েছিল।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩৩
Share:

অভিষেক: নীতীশ কুমার বিজেপিতে যোগ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রিত্বের শপথ নেওয়ার সময়ে বিজেপি নেতা সম্রাট চৌধরির অভিনন্দন, ২৮ জানুয়ারি। ছবি: পিটিআই।

বিজেপি নেতা বিনোদ তাওড়েকে দেশের লোক এক ডাকে চেনেন এমন নয়। মহারাষ্ট্রের নেতা বিনোদ খুব কম বয়সে বিজেপির মুম্বই মহানগর শাখার সভাপতি হয়েছিলেন। শোনা যায়, তাঁর আগে আর কেউ এত কম বয়সে এত গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেননি। তার পরে মহারাষ্ট্রের বিধায়ক হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। এখন তিনি দলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক। বিজেপির ভাষায় রাষ্ট্রীয় মহামন্ত্রী।

Advertisement

আমজনতার কাছে পরিচিত নাম না হলেও বিনোদ তাওড়েকে বিজেপির সংগঠনে সবাই চেনেন। কারণ, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে বিজেপি একটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কী সেই প্রকল্প? গোটা দেশের ১৪৪টি লোকসভা কেন্দ্রকে ‘কঠিন’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে বিজেপি তুলনায় ‘দুর্বল’। এই ১৪৪টি লোকসভা কেন্দ্রে সংগঠন মজবুত করতে বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা বার বার সেখানে যাচ্ছেন। বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। খোদ অমিত শাহ ও জে পি নড্ডার নজরদারিতে কাজ চলছে। প্রথমে ১৪৪টি লোকসভা কেন্দ্র তালিকায় ছিল। পরে তা ১৬০টি করা হয়েছে। এই ১৬০টি আসন জিততে বিজেপি এ বার সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাতে চাইছে।

বিজেপি ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে কতগুলি আসন পেয়েছিল? ৩০৩টি। ৫৪৩ আসনের মধ্যে বিজেপি গত লোকসভা ভোটে ৪৩৬টি কেন্দ্রে লড়েছিল। বিজেপি ১৩৩টি আসনে হেরে গিয়েছিল। এই হারা আসনগুলিও ওই ১৬০টি ‘কঠিন আসন’-এর তালিকায় রয়েছে। এই ১৩৩টি আসনের মধ্যে ৭২টি লোকসভা আসনে বিজেপি ছিল দ্বিতীয় স্থানে। বিজেপি আগামী লোকসভায় ১৬০টি আসনকে ‘টার্গেট’ করছে। যার অর্থ, বিজেপি এ বার আরও বেশি আসনে লড়ে, আরও বেশি আসন জিততে চাইছে। বিজেপির লক্ষ্য, এই ১৬০টি আসনের অন্তত অর্ধেক আসনে জয় ছিনিয়ে নেওয়া। তা হলেই বিজেপির আসন ৩০৩ থেকে বেড়ে ৩৮০ পেরিয়ে যাবে। আর যে ৭২টি আসনে বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে ছিল, সেগুলি জিততে পারলেই বিজেপির আসন-সংখ্যা ৩০৩ থেকে বেড়ে ৩৭৫ হয়ে যাবে।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী মোদী ঠিক এই অঙ্ক থেকেই সংসদে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, বিজেপি আগামী লোকসভা নির্বাচনে ৩৭০টি আসন জিততে চলেছে। তিনি ‘অব কি বার, চারশো পার’-এর রণহুঙ্কার দিয়ে বিজেপির চারশো আসনে জেতার কথা বলেননি। তিনি চারশো আসন জয়ের কথা বলেছেন, তবে এনডিএ-র জন্য। বিজেপি সাড়ে তিনশো আসন জিতবে বলেননি। ‘সাড়ে তিনশো থেকে চারশোর মধ্যে’ বলেননি। মোদী জানেন, স্বাভাবিক নিয়মে গত বারের কিছু জেতা আসনে বিজেপি এ বার হারতে পারে। কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি আসন বিজেপি জেতার লক্ষ্য নিচ্ছে। সেই হিসাব কষেই তিনি বলেছেন, বিজেপি অন্তত ৩৭০টি আসন জিতবে। বিজেপি গত লোকসভা ভোটে যে ৭২টি আসনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল, তার মধ্যে ৫৬টি আসনে বিজেপি হেরেছিল আঞ্চলিক দলের কাছে। এর মধ্যে ২১টি আসনে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল। ১১টি আসনে বিজেপিকে টেক্কা দিয়েছিল ওড়িশার বিজু জনতা দল। ১০টি আসনে বিজেপিকে হারিয়েছিল মায়াবতীর বিএসপি। মাত্র ১৬টি আসনে কংগ্রেস বিজেপিকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল। রাজ্যভিত্তিক দেখলেও এই ৭২টি আসনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসন পশ্চিমবঙ্গে। তার সঙ্গে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, তামিলনাড়ু। যেখানে কংগ্রেস তেমন শক্তিশালী নয়। বিজেপির মূল লড়াই আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে। যে সব রাজ্যে বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের মুখোমুখি লড়াই, সেখানে বিজেপি অনেক এগিয়ে রয়েছে। অর্থাৎ, ৩০৩ থেকে ৩৭০-এর লক্ষ্যে বিজেপির আসন বাড়ানোর দৌড়ে মূল বাধা আঞ্চলিক দলগুলি। কংগ্রেস নয়।

এখানেই আসল ধাঁধা। সদ্য শেষ হওয়া সংসদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লোকসভা ও রাজ্যসভায় দু’বার বক্তৃতা করলেন। দুই জায়গাতেই তিনি বিজেপির ৩৭০ আসনে জয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। একই সঙ্গে দুই বক্তৃতাতেই তিনি এক ও একমাত্র কংগ্রেসকে নিশানা করলেন। লোকসভা ভোটের আগে শেষ সংসদ অধিবেশনে তিনি স্পষ্ট করে দিলেন, ভোটের প্রচারেও তাঁর মূল নিশানায় থাকবে কংগ্রেস। এবং অবশ্যই রাহুল গান্ধী।

মোদী তাঁর বক্তৃতায় বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে নিশানা করেননি। বিরোধী মঞ্চের অন্য শরিকদেরও আক্রমণে যাননি। তাঁর ‘পাখির চোখ’ থেকেছে শুধু কংগ্রেস। মোদীর রণকৌশল থেকে স্পষ্ট, তিনি বিরোধী জোটে কংগ্রেসকেই সবচেয়ে দুর্বল বলে প্রতিপন্ন করতে রাহুল গান্ধী তথা কংগ্রেস নেতৃত্বকে হেয় করতে চাইছেন। কারণ তিনিও জানেন, কংগ্রেসই হল বিরোধী জোটের নিউক্লিয়াস। আঞ্চলিক দলগুলি যতই ভাল ফল করুক, নিজের রাজ্যের নির্দিষ্ট কিছু আসনের বেশি তাদের পক্ষে জেতা সম্ভব নয়। কিন্তু কংগ্রেস দেড়শোর বেশি আসন জিততে পারলেই বিরোধী জোট সরকার গঠনের জায়গায় চলে যেতে পারে, তা নরেন্দ্র মোদীর জানা। নরেন্দ্র মোদী ঠিক এইখানেই লোকসভা ভোটকে বিজেপি বনাম কংগ্রেসের লড়াই হিসাবে তুলে ধরতে চাইছেন। আরও স্পষ্ট করে বললে তিনি লোকসভা নির্বাচনকে ফের নরেন্দ্র মোদী বনাম রাহুল গান্ধীর লড়াইয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন। তিনি জানেন, লোকসভা ভোটকে মানুষ বিজেপি বনাম কংগ্রেসের লড়াই হিসাবেই দেখবে। ইন্ডিয়া জোটের কোনও ঘোষিত নেতা থাকুক বা না থাকুক, কংগ্রেসই অঘোষিত নেতা। তাই কংগ্রেস নেতৃত্বকেই নিশানা করা জরুরি। রাহুল গান্ধী ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’য় ব্যস্ত। তিনি সংসদের অধিবেশনে এক দিনও যোগ দেননি। তা সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদী তাঁর বক্তৃতায় রাহুল গান্ধীর নাম না করে তাঁকে নিশানা করেছেন। রাহুলের জন্য কংগ্রেসের অন্যান্য তরুণ, প্রতিশ্রুতিমান নেতাদের দমিয়ে রাখা হচ্ছে বলেও কংগ্রেসের অন্দরে ফাটল ধরাতে চেয়েছেন। কংগ্রেসকে হেয় করে তিনি ভোটারদের সামনে আসলে দু’টি বিকল্প তুলে ধরতে চেয়েছেন। নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি না কি রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস?

এতে সন্দেহ নেই যে, বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোট মোদী-শাহের বিজেপিকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল। মূলত তিনটি রাজ্যে জোট নিয়ে বিজেপির চিন্তা ছিল। মহারাষ্ট্র, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ। বিজেপি মহারাষ্ট্রে বিরোধী জোট ভাঙতে পারেনি। তবে জোটের তিন শরিক, শিবসেনা, এনসিপি ও কংগ্রেসের মধ্যে একে একে ভাঙন ধরিয়েছে। বিহারে বিজেপি বিরোধীদের মহাগঠবন্ধন থেকে নীতীশ কুমারকে নিজেদের দিকে টেনে এনেছে। বার বার ডিগবাজি খাওয়ার জন্য নীতীশের সমালোচনা করতেই পারেন। বাস্তব হল, মোদী-শাহও ডিগবাজি খেয়ে নীতীশের হাত ধরেছেন। মহিলাদের সম্পর্কে নীতীশের মন্তব্য নিয়ে যে নরেন্দ্র মোদী বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর নিন্দা করেছিলেন, যে অমিত শাহ নীতীশের জন্য দরজা বন্ধ বলেছিলেন, তাঁরাই এখন নীতীশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হাসি মুখে ছবি তুলছেন।

থাকল পড়ে পশ্চিমবঙ্গ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। সেখানেই থামেননি। কংগ্রেস গোটা দেশে চল্লিশটি আসনও পাবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। নরেন্দ্র মোদী মমতার এই কথাকেই অস্ত্র করে কংগ্রেসকে বিঁধেছেন। এতে যদি আঞ্চলিক দলগুলি মনে করে, তারা নিরাপদে রয়েছে, তা হলে ভুল করবে। কারণ, মোদী আসলে লোকসভা ভোটকে বিজেপি-কংগ্রেসের লড়াইয়ের চেহারা দিয়ে আঞ্চলিক দলগুলিকেই জাতীয় নির্বাচনে গুরুত্বহীন করে ফেলতে চাইছেন। মমতার সুরে নরেন্দ্র মোদী কংগ্রেসকে আক্রমণ করছেন দেখে তৃণমূল নেতৃত্ব যদি মনে করেন, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে আর আসন বাড়ানোর চেষ্টা করবে না— ভুল করবেন।

২০১৪ থেকে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপি সব থেকে বেশি আসন বাড়িয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে— এক লাফে ১৬টি। ভোটের হার বেড়েছিল ২৩.৬ শতাংশ। গত লোকসভা ভোটে বিজেপি যে ৭২টি আসনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল, তার মধ্যে ২২টি আসনই পশ্চিমবঙ্গে। এই ৭২টি আসন জিতেই মোদী ৩৭০ আসন জেতার পূর্বাভাস জানিয়েছেন। বিনোদ তাওড়ে এখন সেই লক্ষ্য পূরণেই ব্যস্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন