Uniform Civil Code

আমরা কি প্রশ্ন তুলতে পারব

রাজনীতি আগামী দিনে কী হতে চলেছে, তা নির্ভর করছে বিরোধী দল এবং সংগঠনগুলো কী প্রক্রিয়ায় এই ভিন্নতাকে রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট হচ্ছে, তার উপর।

Advertisement

সুমন সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৩ ০৪:২৪
Share:

—প্রতীকী ছবি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মধ্যপ্রদেশের ভোপাল থেকে একটা বিতর্ক ছুড়ে দিয়েছেন যে, একই পরিবারে কি দুই রকমের আইন চলতে পারে? যদি তা না গ্রহণযোগ্য হয়, তা হলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গেই দেশ জুড়ে নানা মহল থেকে এই বিধি চালু করার পক্ষে বিপক্ষে মতামত আসতে শুরু করল। সরকারের হয়ে সওয়াল করা শুরু করলেন শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী, এমনকি উপরাষ্ট্রপতিও। কারও যেন তর সইছে না। এখনই চালু করতে হবে ওই আইন।

Advertisement

বলে দিতে হবে না, কেন কেন্দ্রের শাসকরা এই বিষয়টি নিয়ে এত তাড়াহুড়ো করছেন। তাঁরা জানেন যে, আগামী নির্বাচনে তাঁদের শেষ এবং একমাত্র হাতিয়ার— বিভাজন, এবং তাকে সামনে রেখেই তাঁদের নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে হবে। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে শুধু নয়, আদিবাসী এবং জনজাতির মানুষদের সঙ্গে অন্যান্যের এমনকি উদারনৈতিক মানুষদের মধ্যেও যদি বিভাজন না ঘটানো যায়, তা হলে আগামী নির্বাচনে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে শাসক দলকে।

১৯৫১ সালে, ভারতীয় জনসঙ্ঘ পার্টির ইস্তাহারে, ‘হিন্দু কোড বিল’কে উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, কোনও সামাজিক সংস্কারই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়, এই ধরনের কোনও আইন চালু করার তাগিদ সমাজের ভিতর থেকেই আসা উচিত। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনী ইস্তাহারে প্রথম ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ চালু করার প্রস্তাব রাখা হয়। তার পর থেকে যদিও এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা স্তিমিতই ছিল, কিন্তু আশির দশকে, শাহ বানো মামলার রায় বেরোনোর পরে, সেই আলোচনা আবার সামনের সারিতে চলে আসে। কংগ্রেস মুসলমানদের তোষণ করছে, এই আওয়াজ উঠতে শুরু করে। আজও প্রধানমন্ত্রী সেই শাহ বানোর রাজ্য থেকেই এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার পক্ষে সওয়াল করছেন।

Advertisement

এমনিতেই মানুষ মেনে নিতে এবং মানিয়ে নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে আজকাল সরকারের কোনও সিদ্ধান্তকেই প্রশ্ন করতে ভুলে গেছেন। নোটবন্দি ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এই প্রক্রিয়া আসলে ‘কালো টাকা’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সে দিন সরকারের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া জরুরি ছিল, ‘কালো টাকা’ বলতে সরকার কী বুঝিয়েছিল। তা না করে প্রতিটি নাগরিক কিন্তু ব্যাঙ্কের সারিতে দাঁড়িয়ে, নিজের কষ্টার্জিত টাকা বদল করতে নেমে গিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে এই শাসক দল নাগরিকত্ব আইন পাশ করিয়েছিল। তখনও কিন্তু মুসলমানদের বাদ দেওয়া নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল এবং তার সঙ্গে দেশের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো থেকেও এই আইনের বিরোধিতা হয়েছিল। তার পর প্রায় চার বছর কেটে গেলেও এই নাগরিকত্ব আইন সংক্রান্ত বিধি কেন্দ্রীয় সরকার তৈরি করতে পারেনি, অথচ মাঝেমধ্যে নির্বাচন এলেই আওয়াজ ওঠে, সমস্ত অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের দেশ থেকে বিতাড়ন করতে হবে। এই নাগরিকত্ব আইন বলতে কী বোঝায়, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী কারা? যাঁর কাছে সরকার অনুমোদিত শংসাপত্র নেই বা প্রয়োজনীয় কাগজ নেই, তিনিই কি তবে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’? এই সব প্রশ্ন ওঠা পারতপক্ষে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যে দিন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হল, আধারের সঙ্গে প্যান কার্ড বা ভোটার কার্ডের সংযোগ না করলে, প্যান কার্ড এবং ভোটার কার্ড অকার্যকর হয়ে যাবে, বা সরকারি রেশন এবং অন্যান্য সুবিধা মিলবে না, তখন প্রশ্ন করা উচিত ছিল না, প্রাথমিক যে দুটো পরিচয়পত্র দেখিয়ে ‘স্বেচ্ছায়’ নেওয়া একটি প্রমাণ করার হাতিয়ারকে সেই পরিচয়পত্রের সঙ্গে সংযুক্ত কেন করতে হবে? কিন্তু সেই প্রশ্ন করতে নাগরিকদের— না গণমাধ্যম না বিরোধী দলগুলো— কেউ উদ্ধুদ্ধ করেনি।

আজও আবার সরকারকে প্রশ্ন করার সময়: অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কাকে বলে? কী কী অভিন্ন হতে হবে এই আইন চালু করতে? যে সমস্ত প্রথা এই মুহূর্তে সারা দেশে চলছে, তার কোনটা-কোনটা পরিবর্তন করতে হবে, এই আইন চালু করতে? ভারতের সংবিধান তো প্রতিটি নাগরিককে তাঁর নিজস্ব প্রথা অনুশীলন করার অধিকার দিয়েছে, তা হলে কেন এই আইন চালু করার প্রয়োজন হচ্ছে? অভিন্নতার মধ্যে যে ভিন্নতা আছে, তার মধ্যেই তো ভারতের বৈচিত্র। অবশ্যই মুসলমান সমাজের বিচ্ছেদ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে, কিন্তু প্রশ্ন করতে হবে, জনজাতিদের জন্য বা অন্য সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য কি সারা দেশে একই আইন চালু হতে পারে? আসলে শাসক দলের প্রধান দু’জন ব্যক্তি হয়তো ভাবছেন, বিভাজনের রাজনীতি করেই তাঁরা আগামী নির্বাচনে জিতে যাবেন, কিন্তু বিরোধী দল এবং অন্য সামাজিক সংগঠনগুলো যদি শাসক দলের পাতা ফাঁদে পা না দেয়, যদি প্রশ্ন তোলে যে আইন কমিশনও তো ২০২১ সালে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর সপক্ষে মত দেয়নি, তা হলে কেন এই আইন চালু করতে হবে— তা হলেই রাজনীতি অন্য রকম হতে পারত। রাজনীতি আগামী দিনে কী হতে চলেছে, তা নির্ভর করছে বিরোধী দল এবং সংগঠনগুলো কী প্রক্রিয়ায় এই ভিন্নতাকে রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট হচ্ছে, তার উপর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন