দেশের সংসদে বিরোধীরা সরব সমালোচনাও করতে পারবেন না?
Suspension OF MPs

ফাঁকা মাঠে খেলা হবে

পাঁচ বছর পরে সপ্তদশ লোকসভার শেষ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন চলছে। বিরোধীরা সরব ও সক্রিয় হলেই তাঁদের দলে দলে সাসপেন্ড করে দেওয়া হচ্ছে।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:২৩
Share:

ঠাঁইহারা: সংসদের দুই কক্ষ থেকে বহিষ্কৃত সাংসদরা, দিল্লি, ১৯ ডিসেম্বর। ছবি: পিটিআই।

সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদের ভূমিকা এবং সক্রিয় বিরোধিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের সংখ্যা কত, তা নিয়ে বিরোধীদের দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।

Advertisement

কে বলেছিলেন? নরেন্দ্র মোদী। কবে? ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তিনশোর বেশি আসনে জিতে দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে। কখন? সপ্তদশ লোকসভার প্রথম অধিবেশন শুরুর আগে। প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছিলেন, “আমি আশা করব, বিরোধীরা সরব হবেন। সংসদে সক্রিয় হবেন।”

পাঁচ বছর পরে সপ্তদশ লোকসভার শেষ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন চলছে। বিরোধীরা সরব ও সক্রিয় হলেই তাঁদের দলে দলে সাসপেন্ড করে দেওয়া হচ্ছে। লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে সাসপেন্ড হওয়া সাংসদের সংখ্যা দেড়শো ছুঁই-ছুঁই। তালিকায় শশী তারুর থেকে ফারুখ আবদুল্লা, কেউ বাদ নেই। মাস তিনেকের মধ্যেই লোকসভা নির্বাচন। তার আগে, সংসদ এখন কার্যত বিরোধী-মুক্ত।

Advertisement

বিরোধী সাংসদদের ‘অপরাধ’ কী? তাঁরা সংসদ ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা টপকে দুই যুবকের লোকসভায় ঢুকে পড়া নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বিবৃতি চেয়েছেন। পদত্যাগ চাননি। শুধু বিবৃতি। অমিত শাহ লোকসভা বা রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে একটি বিবৃতি পাঠ করবেন। ঘটনার তদন্ত চলছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থায় খামতি খতিয়ে দেখা হচ্ছে জানাবেন। সেই ফাঁকফোকর বুজিয়ে ফেলে দোষীদের শাস্তি হবে বলে আশ্বাস দেবেন। এইটুকুই। দেশের নিরাপত্তার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাঁধে। দিল্লির আইন-শৃঙ্খলা, দিল্লি পুলিশও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন। তাই তিনিই বিবৃতি দেওয়ার যোগ্য ব্যক্তি।

সংসদের অধিবেশন চলাকালীন কোনও ঘটনা ঘটলে তা নিয়ে সরকার বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের প্রথমে সংসদে বিবৃতি দেওয়াটাই দস্তুর। না হলে মন্ত্রীর বিরুদ্ধেই স্বাধিকার ভঙ্গের অভিযোগ উঠতে পারে। সে দিন যেমন কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলছিলেন, ইউপিএ সরকারের পরিবেশ বা গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী থাকাকালীন কয়েক বার তিনি কোনও বিষয়ে সংসদের বাইরে মুখ খুলে ফেলেছিলেন। বিরোধীর আসন থেকে সুষমা স্বরাজ, মুরলীমনোহর জোশীরা আপত্তি তোলায় তাঁকে ভুল স্বীকার করে সংসদে বিবৃতি দিতে হয়েছিল। এখন উল্টো নিয়ম। সংসদে হাঙ্গামা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দু’জনেই সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলেছেন। দু’জনের কেউই সংসদে মুখ খুলতে রাজি নন। অথচ গোটা ঘটনাটাই সংসদে ঘটেছে।

যে কোনও দেশেই কোনও একটি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে এবং শাসক দলের নেতৃত্বে কোনও দোর্দণ্ডপ্রতাপ ও প্রবল জনপ্রিয় নেতা থাকলে সংসদ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। একই নিয়মে গত দশ বছরে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সংসদকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। মণিপুরের হিংসা হোক বা দেশের বেকারত্বের সমস্যা নিয়ে মোদী সরকারকে সংসদে আলোচনায় রাজি করাতে বিরোধীদের এখন কালঘাম ছুটছে। সংসদে আলোচনা ছাড়াই নোট বাতিলের মতো বড় মাপের আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তার থেকেও বিপজ্জনক প্রবণতা হল, সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা ছাড়া বিল পাশ করানো। চতুর্দশ লোকসভার স্পিকার, প্রয়াত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রায় সমস্ত বিল খুঁটিনাটি আলোচনার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাতে সংসদ যে আইন তৈরি করছে, তাতে যেন কোনও ত্রুটি না থাকে। এখন সংসদীয় কমিটিতে চুলচেরা বিচার ছাড়াই বিল পাশ হয়ে চলেছে। আইনে ত্রুটি থাকলে ভবিষ্যতে আইনি সমস্যা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

বিরোধীদের অন্ধকারে রেখে শেষ মুহূর্তে বিল নিয়ে এসে তাড়াহুড়ো করে বিল পাশ করিয়ে নেওয়া আরও একটি বিপজ্জনক প্রবণতা। যে কোনও বিল পেশের পরে তা নিয়ে আলোচনার আগে সাংসদদের প্রস্তুতির জন্য অন্তত দু’দিন সময় দেওয়াই প্রথা। অথচ কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা রদ করা ও জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য ভেঙে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিল যে দিন পেশ হয়, সে দিনই তা পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তিন কৃষি আইনের ক্ষেত্রেও বিরোধীদের কোনও আপত্তি না শুনে, প্রথমে অধ্যাদেশ জারি করে, তার পরে সংসদে তাড়াহুড়ো করে তিন বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হয়।

মোদী জমানার গোড়ার দিকে লোকসভায় বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও রাজ্যসভায় তা ছিল না। ফলে লোকসভায় অনেক বিল পাশ হলেও তা রাজ্যসভায় আটকে যেত। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই ইউপিএ সরকারের জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন আইনে সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করে। তাতে জমি অধিগ্রহণের রাস্তা সহজ করে দেওয়া হয়। লোকসভায় পাশ হলেও সেই বিল রাজ্যসভায় আটকে যায়। অথচ অধ্যাদেশ জারির ফলে পাঁচ মাস সংশোধিত আইন জারি ছিল। সেই সময় আইনের ফাঁক গলে কোথায় কত জমি অধিগ্রহণ হয়েছে, তার কোনও হিসাব মেলেনি।

রাজ্যসভার বাধা কাটাতে মোদী সরকার যে কোনও বিলকে অর্থ বিলের তকমা দিয়ে লোকসভায় পাশ করানো শুরু করেছিল। কারণ অর্থ বিল লোকসভায় পাশ হলে তা রাজ্যসভা আটকাতে পারে না। ২০১৬-র আধার বিল এই ভাবেই পাশ হয়। একাধিক ক্ষেত্রে অনেক আইনে সংশোধনও বাজেটের অর্থ বিলের মাধ্যমে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়। যেমন, বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইনে সংশোধন করে রাজনৈতিক দলগুলির জন্য বিদেশি সংস্থার চাঁদার রাস্তা খোলা। অরুণ জেটলি এমন ভাবে আইনে সংশোধন করেছিলেন যাতে অতীতে কোনও দল বিনা অনুমতিতে চাঁদা নিয়ে থাকলেও অসুবিধা হবে না। সবটাই অর্থ বিলের মাধ্যমে।

যে কোনও সরকারই সংসদকে এড়িয়ে কার্যসিদ্ধির নানা ফন্দি খোঁজে। মোদী সরকারের বাড়তি বিশেষত্ব হল, বিরোধীরা কোনও দাবি তুললে তা কোনও ভাবেই মানা হবে না বলে সরকারের জেদ। হয়তো মণিপুরের হিংসা নিয়ে সরকারের আলোচনায় এমনিতে আপত্তি নেই। কিন্তু বিরোধীরা দাবি তুলেছেন তাঁরা আলোচনা করবেন না, ব্যাপারটা অনেকটা এই রকম। এখন বোধ হয় সেই জেদের বশেই সরকার সংসদে হাঙ্গামা নিয়ে সংসদেই বিবৃতি দিতে নারাজ। আর বিরোধীরা তা নিয়ে দাবি তুললেই তাঁদের বিরুদ্ধে সংসদ অচল করে দেওয়ার অভিযোগ এনে সাসপেন্ড করে দেওয়া হচ্ছে। তার পর ফাঁকা ময়দানে, বিরোধী-মুক্ত সংসদে ভারতীয় ন্যায় ও দণ্ড সংহিতার তিনটি বিলও পাশ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

দেখেশুনে বাম নেতারা তো বটেই, কংগ্রেস নেতারাও ১৯৩৩ সালে হিটলারের জার্মানির কথা স্মরণ করছেন। সে বছর জার্মানিতেও মার্চ মাসে ভোট ছিল। তার আগে ২৭ ফেব্রুয়ারি জার্মান পার্লামেন্ট রাইখস্ট্যাগে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। নাৎসিরা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে সমস্ত কমিউনিস্ট সাংসদদের গ্রেফতার করে। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সাংসদদের সাসপেন্ড করা হয়। বিনা বাধায় পার্লামেন্টের সম্মতি ছাড়াই আইন প্রয়োগের ক্ষমতা সংক্রান্ত বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হয়। শুধু বিরোধী সাংসদদের সাসপেন্ড নয়, এখন বিজেপি নেতারাও সংসদে হাঙ্গামার পিছনে কংগ্রেস-তৃণমূল-কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। এমন নয় যে, বিজেপি কোনও দিন সংসদ অচল করেনি। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ২০১৩ থেকে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত বিজেপি একের পর এক অধিবেশনে সংসদ অচল করে রেখেছিল। মনমোহন সিংহ নীরব থাকতেন। অভিযুক্ত মন্ত্রীরা জবাব দিতেন না। তার খেসারতও কংগ্রেসকে ভোটে দিতে হয়েছিল। তবে সংসদ অচল করার জন্য বিজেপি সাংসদদের দলে দলে সাসপেন্ড করা হয়নি।

গত সোমবার রাজ্যসভায় এক ধাক্কায় ৪৫ জন বিরোধী সাংসদকে সাসপেন্ড করার পরে রাজ্যসভা যখন মুলতুবি হয়ে গিয়েছে, তখন তৃণমূল সাংসদ দোলা সেন রাজ্যসভার দলনেতা, বিজেপির মন্ত্রী পীযূষ গয়ালকে ডেকে বলছিলেন, “২০১৩-১৪’র কথা কি ভুলে গেলেন!” পীযূষ গয়াল হেসেছিলেন। তাঁর কাছে কোনও উত্তর ছিল না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন