G20 Summit 2023

মেরুকরণ থেকে মধ্যপন্থা

দীর্ঘ দিন ধরে বিশ্ব রাজনীতির উপর আধিপত্য বিস্তার করার পর, এখন বৃহৎ শক্তিরা বুঝতে শুরু করেছে যে মাঝারি শক্তির অধিকারী দেশগুলিকে অগ্রাহ্য করে আর কোনও বড় মাপের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

Advertisement

প্রণয় শর্মা

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:৩৭
Share:

জি২০ সম্মেলন। —ফাইল চিত্র।

গত কয়েক মাসে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটা পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে, যা তাৎপর্যপূর্ণ। দীর্ঘ দিন ধরে বিশ্ব রাজনীতির উপর আধিপত্য বিস্তার করার পর, এখন বৃহৎ শক্তিরা বুঝতে শুরু করেছে যে মাঝারি শক্তির অধিকারী দেশগুলিকে অগ্রাহ্য করে আর কোনও বড় মাপের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। ভারত, ব্রাজ়িল, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ইরান, মিশর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, এমনকি তুরস্ক বা ইথিয়োপিয়ার মতো দেশও এখন আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চে পাদপ্রদীপের সামনে আসতে শুরু করেছে।

Advertisement

এখন বিশ্বে যে সব প্রধান চ্যালেঞ্জ নিয়ে সবাইকে মাথা ঘামাতে হচ্ছে— যেমন, ইউক্রেনে যুদ্ধ, আমেরিকা ও চিনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই, বা জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা— এর কোনওটারই সমাধান সম্ভব নয়, যদি মাঝারি শক্তির দেশগুলি এগিয়ে না আসে।

এই মাঝারি মাপের শক্তিগুলি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল, বা অনুন্নত দেশ। এই সঙ্গে ওশিয়ানিয়া, অর্থাৎ প্রশান্ত মহাসাগরের উন্নয়নশীল দ্বীপরাষ্ট্রগুলিকেও (যেমন পাপুয়া নিউ গিনি, ফিজি প্রভৃতি) ধরতে হবে। এত দিন পর্যন্ত এই দেশগুলি আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমি দুনিয়ার ধনী দেশগুলির বেঁধে দেওয়া নিয়ম মেনেই কমবেশি চলত।

Advertisement

ক্ষমতার এই নকশা এখন বদলাতে শুরু হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত জি২০ (২০টি দেশের জোট) শীর্ষ সম্মেলনেই বোঝা গেল, এই মাঝারি শক্তির দেশগুলির চাহিদা ও দাবি উপেক্ষা করে বিশ্বের প্রধান প্রধান চ্যালেঞ্জের সমাধান করা যাবে না। যদিও অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস করে, তবুও এত দিন পর্যন্ত তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনকে বিশ্ব রাজনীতিতে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হত না। কিন্তু এখন আর বিশ্ব রাজনীতি শুধুই আমেরিকা এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী চিন ও রাশিয়ার মধ্যে টানাপড়েনের উত্তেজনায় আবদ্ধ নেই। মাঝারি শক্তির দেশগুলি, এমনকি আরও ছোট দেশগুলিও কী ভাবে ইউক্রেন যুদ্ধ বা বিশ্ব উষ্ণায়নের মতো প্রশ্নে কী অবস্থান নিচ্ছে, সে দিকে তাকাতে হচ্ছে আমেরিকা, রাশিয়া, চিনকেও।

এত দিন পর্যন্ত জি২০ গোষ্ঠীতে বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তিতে অগ্রগণ্য ১৯টি দেশ, এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সদস্য ছিল। এ বার তার সঙ্গে আফ্রিকান ইউনিয়ন নতুন সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হল। সময় বদলাচ্ছে, এটা তারই একটা ইঙ্গিত।

দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এ বারের জি২০ শীর্ষ বৈঠকে আলোচিত বিভিন্ন প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারা এবং সম্মেলন শেষে একটা ঘোষণাপত্র তৈরি করতে পারার জন্য কৃতিত্ব অবশ্যই ভারত-সহ বিভিন্ন মাঝারি শক্তির দেশগুলিকে দিতে হবে। বলা যেতেই পারে যে ধনী দেশগুলি ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজটা সাফল্যের সঙ্গে করার মধ্য দিয়ে সম্মেলনের আয়োজনকারী দেশ ভারত, এবং সেই সঙ্গে অন্য উন্নতশীল দেশগুলি তাদের কূটনৈতিক দক্ষতারই পরিচয় দিয়েছে।

তবে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমের ধনী দেশগুলিও এখন বুঝতে পারছে তারা বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ থেকেই ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। সেই ভাবনা থেকেই তারাও তাদের কৌশল বদলাচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মিউনিখে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সংক্রান্ত বৈঠকে বিষয়টি সামনে চলে আসে। ওই বৈঠক থেকে পশ্চিমি দেশগুলি চেষ্টা করছিল যাতে ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা যায়। কিন্তু দেখা গেল যে, পশ্চিমের এই উদ্যোগে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেরই সায় নেই। এর অন্যতম কারণ, বিশ্বের দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলির কাছে ওই যুদ্ধ তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। বা অন্য ভাবে বললে এটা ইউরোপের সমস্যা যত জরুরি, ততটা বাকি বিশ্বের কাছে নয়। বরং তাদের আগ্রহ ইউক্রেনের যুদ্ধ কবে শেষ হবে, তা নিয়ে। যুদ্ধ প্রলম্বিত হওয়ার জন্য যে ভাবে খাদ্যশস্য, জ্বালানি ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে এবং খাদ্যপণ্যের মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে, তা উন্নয়নশীল দেশগুলির কাছে মাথাব্যথার কারণ।

আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলি রাশিয়াকে দুর্বল করার লক্ষ্যে ইউক্রেন যুদ্ধকে টেনে নিয়ে চলেছে, কিন্তু এর জেরে যে বিশ্বের দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলির কতখানি সমস্যা হচ্ছে, তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই— এই উপলব্ধি থেকেই তারা মিউনিখ সম্মেলনে পশ্চিমের ধনী দেশগুলির পাশে দাঁড়ায়নি। সাম্প্রতিক অতীতে কোভিড অতিমারির সময়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা এই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির স্মৃতিতে এখনও জাগ্রত। যখন তারা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের জন্য হাহাকার করছিল, তখন ধনী দেশগুলি নিজেদের কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভ্যাকসিন মজুত করে রেখেছিল।

এখন দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের জন্য আমেরিকা ও চিনের মধ্যে লড়াইয়ে এই মাঝারি শক্তির দেশগুলি দুই দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক রেখে চলা, এবং তার সঙ্গে নিজের দেশের স্বার্থ মজবুত করার চেষ্টা করছে। কোনও একটি পক্ষ না নিয়ে, দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। এটাই এখন নতুন বাস্তব। দিল্লির জি২০ শীর্ষ সম্মেলনেই সম্ভবত দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে বিশ্ব রাজনীতিকে বিভক্ত করার বদলে বহুমাত্রিক শক্তিবিন্যাসের ভিতটা গাঁথার কাজ শুরু হয়েছে। এক কথায়, নতুন একটা আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণ তৈরি হচ্ছে, যার কেন্দ্রে থাকছে মাঝারি মাপের শক্তির দেশগুলি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন