Society

প্রতীক খাটিয়া, কিংবা জাহাজ

ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, খাটিয়া, জাহাজ, সিসি টিভি— এমন নানা প্রতীক চিহ্ন অফিসে অফিসে নির্দল প্রার্থীরা একে একে তুলে নেন। প্রতি ভোটে, প্রতি জেলা-মহকুমায়।

Advertisement

সন্দীপন নন্দী

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:২৫
Share:

—প্রতীকী ছবি।

এ আবার কেমন সম্পত্তির হলফনামা? লোকসভা ভোটে দাঁড়ানোর জন্য প্রার্থীকে জানাতে হয়, কত সম্পদ রয়েছে তাঁর। নাম-লেখাতে আসা এই প্রার্থীর হলফনামার পাতা জুড়ে শুধুই শূন্যের গড়াগড়ি! গাড়ি নেই, বাড়ি নেই, অর্থ নেই। সর্বময় শূন্যের নীচে জ্বলজ্বল করছে বাংলা স্বাক্ষরটি। কিছুই কি নেই আপনার? উত্তরে সেই নির্দল প্রার্থী বলেন, “আমার সম্পদ মনের জোর।” সে বস্তুটি নেহাত ফেলনা নয়— গত বিধানসভা নির্বাচনে আটশোটি ভোট এনে দিয়েছিল তাঁর ঝুলিতে। জামানত জব্দ হলেও, ফের লোকসভা ভোটে দাঁড়ানোর স্পর্ধা দেখিয়েছেন বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের এই নির্দল প্রার্থী। আজ অবধি শহরে, গ্রামের কোনও দেওয়ালে যাঁর নাম লেখা হয়নি। কেউ মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বলেননি, এই প্রার্থীকে অমুক চিহ্নে ভোট দিন। তার মানে এই নয় যে, তাঁর বলার মতো কথা নেই। সরকারি দফতরে দাঁড়িয়ে বলে গেলেন— কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দিতে হবে, হিন্দির প্রতাপ রুখে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি অফিসে বাংলা ভাষার ব‍্যবহার বাধ‍্যতামূলক করতে হবে। সরকারি অফিসের করিডর সেই মুহূর্তে হয়ে উঠল এক নির্দল প্রার্থীর রোড শো। শ্রোতা বলতে কিছু কর্মক্লান্ত করণিক, আর ঘরের প্রাণহীন কয়েকটি দেওয়াল। জানালেন, বেসরকারি বড় চাকরি ছেড়ে ‘দেশের স্বার্থ’-এ গৃহশিক্ষকতা করেন। সেটাই এখন তাঁর ডালভাতের উৎস। প্রতীক চিহ্ন নিয়েও তাঁর তেমন চাহিদা নেই। সবার শেষে যা থাকবে, তা-ই নেবেন।

Advertisement

ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, খাটিয়া, জাহাজ, সিসি টিভি— এমন নানা প্রতীক চিহ্ন অফিসে অফিসে নির্দল প্রার্থীরা একে একে তুলে নেন। প্রতি ভোটে, প্রতি জেলা-মহকুমায়। গণতন্ত্রের বৃহত্তম উৎসবে কিছু পাইকারি প্রতীক, বহু নির্বাচনে বহু প্রার্থীর উচ্ছিষ্ট। তবু সেই সব নগণ‍্য প্রতীকই এই নির্দল প্রার্থীদের হাতে গণতন্ত্রের বজ্রমানিক। তা দিয়ে আশার মালা গাঁথতে থাকেন একের পর এক নির্বাচনে। যেমন মনোনয়ন জমা দিলেন সত্তর-পেরোনো এক প্রার্থী। তিনি ‘নমিনেশন হল’-এর এক বিস্ময়পুরুষ। এই প্রাক্তন প্রাথমিক শিক্ষক বরাবর একাই ভোটে লড়েন। ঘর ছাড়ার আগে বলে গেলেন, “এই অভাগা দেশে নিজের নামের পাশে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ লেখা দেখতে বড় ভাল লাগে।”

এমন নয় যে, নির্বাচনকে এঁরা লঘু রসিকতা বলে মনে করেন। কুড়ি বছর ধরে একই কৌশলে ওই শিক্ষক-প্রার্থী তাঁর ভোটপ্রচার করে চলেছেন। কী রকম? ভাঙাচোরা এক ট্যাক্সির চালে মাইক বেঁধে ধানখেতের আনাচকানাচ থেকে কাশিয়াখাঁড়ির নরম মাটির আলপথ ধরে রোজ প্রচার করেন তিনি। এক নির্দল প্রার্থীর হয়ে বছর বছর লড়ে যান এক প্রান্তিক ট্যাক্সিচালক, এ-ও তো কম আশ্চর্য নয়! এ সব কথা শিরোনামে ওঠে না, এ সব প্রার্থীও সংবাদের ধার ধারেন না। পঞ্চায়েত, বিধানসভার ভোটে ভরাডুবি পেরিয়েও লোকসভার ময়দানে হাজির ওই প্রার্থী। তাঁর আন্দাজ, এ বার অন্তত চার হাজার ভোট তিনি পাবেন। তাঁর সাহসের উৎস তাঁর আদর্শ— নেতাজি। যদি জেতেন, কী করবেন? বৃদ্ধ সকলকে আশ্বস্ত করলেন, তিনি জিতে এলে সিবিএসই, আইসিএসই পরীক্ষার মতো, সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়েও অভিন্ন সিলেবাস চালু হবে।

Advertisement

বড় রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে অযুত-নিযুত কোটি টাকা নিয়ে ভোটের খেলায় নেমেছে, সেখানে এই প্রান্তিক মানুষদের পরাজয় নিশ্চিত। তবু ভারত যে ইচ্ছে নিয়ে এক দিন ব্রাজ়িলের সঙ্গে ফুটবল খেলতে চায়, যে ভাবে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের ইচ্ছে লালন করছে আফগানিস্তান, সেই অ-সম্ভব আকাঙ্ক্ষা নিয়েই বড় দলগুলোর সঙ্গে লড়েন এই নির্দল প্রার্থীরা। গণনাকক্ষে যে নামগুলোর পাশে ভোটপ্রাপ্তির সংখ্যা ডজন-একশো ছাড়ায় না। ভোটের মেশিন তাঁদের আশাভঙ্গের নীরব সাক্ষী।

মাইকে ঘোষণা হল, আর আধঘণ্টা পরে নমিনেশন পর্ব শেষ। তখনও শেষ কাজটুকু সারছেন জনজাতি সম্প্রদায়ের এক নির্দল প্রার্থী। “আমার ব্লাডেই সংঘর্ষ,” বললেন তিনি। জেতাই শেষ কথা নয়, এ এক দীর্ঘ দিনের লড়াই। গল্প শোনালেন, কিশোরবেলায় সিদ্ধার্থশঙ্করের জনসভায় যিনি সটান মঞ্চে উঠে মুখ‍্যমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন এক প্রতিবাদপত্র। সেই শুরু। এই প্রতিবাদ আজও চলছে কুমারগঞ্জের মাঠেঘাটে, মরা ইছামতীর বালুচরে। সে দিন জনজাতি গোষ্ঠীর তরুণ গাছতলায় চাকরির নিয়োগপত্র দানের প্রতিবাদ করেছিলেন। আজ বৃদ্ধ হলেও এসেছেন মনোনয়নপত্র জমা দিতে, স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে। সংসদীয় গণতন্ত্রের এক নিঃসঙ্গ সম্রাটের মতো চেয়ারে বসে আছেন। কাঁধের ঝোলা ব্যাগে তিন হাজার ছাপানো লিফলেট। সভা নয়, মিছিল নয়, এক টুকরো কাগজ বিলিয়েই গত বিধানসভা ভোটে সাত হাজার মানুষের সমর্থন পেয়েছিলেন এই মানুষটি।

যাওয়ার আগে হাতে গুঁজে দিয়ে গেলেন তাঁর প্রচারপত্র। তাতে লেখা, দায়সারা সংরক্ষণ নয়, জনজাতির প্রয়োজন একটু যত্ন আর ভালবাসা। সমাজ থেকে নেতা বেছে নিতে হবে, সর্বজন হিতায়, সর্বজন সুখায়। জনজাতি সম্প্রদায়ের প্রার্থীর প্রচারপত্রে বাংলা, সংস্কৃত মিলেমিশে একাকার। ছাপা অক্ষরগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, তা থেকে নির্গত হচ্ছে গণতন্ত্রের, ন্যায়ের এক তীব্র বোধ। দলীয় প্রতিযোগিতার ওপারে যে গণতন্ত্র, তার আভাস দিয়ে যায় এ সব অক্ষর। এই প্রার্থীরা দলহীন, কিন্তু বলহীন নন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন