Social Media

হাসির দৈর্ঘ্য, কান্নার ওজন

গণমাধ্যমে গুজবের জন্ম মুদ্রিত মাধ্যমে হলেও, ইন্টারনেট এলে তার কিছু স্বতন্ত্র মৌল বৈশিষ্ট্য এতে যুক্ত হল। লেখার গুণমান, তথ্যের সত্যতা যাচাই, খবরের গুরুত্ব ইত্যাদি দিয়ে নির্ধারিত হয় মুদ্রিত মাধ্যমে তার ‘অবস্থান’।

Advertisement

পৃথু হালদার

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২৪ ০৭:৪০
Share:

—প্রতীকী ছবি।

এক ‘সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার’-এর সারভাইক্যাল ক্যানসারে ‘মৃত্যু’ ও পরে নাটকীয় ‘প্রত্যাবর্তন’-এ আন্তর্জালে শোরগোল উঠল সম্প্রতি। এই ‘স্টান্ট’-এর কারণ নাকি ওই ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি। নেট-নাগরিকেরা দ্বিধাবিভক্ত, অধিকাংশের মত, এমন গুরুতর রোগকে নিয়ে এমন উপহাস কুরুচিপূর্ণ, অসঙ্গত। অন্য মত, এ যুগে পণ্যরতির যে বাড়বাড়ন্ত, তারই ক্রমপরিণতি হিসাবে দেখা উচিত একে।

Advertisement

ফরাসি দার্শনিক জ বদ্রিলার্ড দেখিয়েছিলেন, উপসাগরীয় যুদ্ধ আদতে হয়নি, মিডিয়া যুদ্ধ-যুদ্ধ রব তোলে, কেউ বাস্তবের খবর রাখে না; যা দেখানো হয়েছে সেটাই বাস্তব হয়ে উঠেছে। বাস্তব ও বয়ানের মধ্যিখানের যে ফারাক, সেটাই এই সময়ের আখ্যান। এতে অবাক হওয়ার, মনুষ্যত্ব কোথায় এসে থেমেছে তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশের চেয়ে বেশি জরুরি ‘ইনফ্লুয়েন্সার-সংস্কৃতি’র পর্যালোচনা, যা এ-হেন দেখনদারির জন্ম দিচ্ছে।

গণমাধ্যমে গুজবের জন্ম মুদ্রিত মাধ্যমে হলেও, ইন্টারনেট এলে তার কিছু স্বতন্ত্র মৌল বৈশিষ্ট্য এতে যুক্ত হল। লেখার গুণমান, তথ্যের সত্যতা যাচাই, খবরের গুরুত্ব ইত্যাদি দিয়ে নির্ধারিত হয় মুদ্রিত মাধ্যমে তার ‘অবস্থান’। এখানে যে কাজ সম্পাদকের, ইন্টারনেটে তা করে উক্ত সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম; বহু ক্ষেত্রেই তা গুণগত বিচারের চেয়ে ‘পপুলারিটি ম্যাট্রিক্স’কে বেশি প্রাধান্য দেয়। মুদ্রিত মাধ্যমে ছাপার অক্ষরে যা প্রকাশ পেল, সেটুকুই পাঠক পড়তে পারেন। ইন্টারনেটে একই সময়ে এক সঙ্গে আদান-প্রদান দুই-ই সম্ভব।

Advertisement

এরও ভালমন্দ আছে, যেমন ‘ফিল্টার বাবল’: আমি যে ধরনের ‘কনটেন্ট’ ভালবাসি, ইন্টারনেট শুধু তা-ই দেখাবে। এর ফলে বিপরীতধর্মী মতামত সম্পর্কে অজ্ঞতার আশঙ্কা থাকে। প্রথাগত প্রিন্ট মিডিয়ায় ভিন্নমত স্থান পায়, ফলে সেখানে মেরুকরণ ডিজিটাল মিডিয়ার চেয়ে একটু হলেও কম হয়।

‘নেটওয়ার্ক সোসাইটি’তে মানুষের অভিরুচি, আবেগ বোঝানোর ভাষা ও ভঙ্গি পাল্টেছে ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্মের চাহিদায়। যে-হেতু ‘ইনফ্লুয়েন্সার ইকনমি’ চলে পপুলারিটি ম্যাট্রিক্স-এ, তাই বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে ইন্টারনেট-সেলেব্রিটিদের যে ‘ফলোয়ার বেস’ তৈরি হচ্ছে তার পুরোটাই এক আস্ত পণ্য বিপণি। কিছু দিন আগে এক জনপ্রিয় ভারতীয় টক শোয়ে আর এক ইনফ্লুয়েন্সার ঘোষণা করেন, তিনি নিজের ‘ডিজিটাল মৃত্যু’র প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁর অফিসে অনেকগুলো কক্ষ, যার একটা ‘প্রাসঙ্গিকতা কক্ষ’। সেখানেই নাকি চলছে মৃত্যুর প্রস্তুতি: যখনই তাঁর টিম দেখবে জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ছে, তখনই নাকি হবে এই মৃত্যু ঘোষণা। মনোযোগ আকর্ষণে কোনও কৌশলই আজ নীতিবিরুদ্ধ নয়।

দার্শনিক রেনে দেকার্ত-এর ঘোষণায় মানুষের অস্তিত্ব নির্ধারিত হয়েছিল ‘চিন্তা করা’ ক্রিয়াপদটি দিয়ে। নেটওয়ার্ক সোসাইটি-র খ্যাত গবেষক ম্যানুয়েল ক্যাস্তেলস ইন্টারনেট-যুগে ব্যক্তির পরিচিতি নিয়ে কাজ করেছেন; তিনি দেখিয়েছেন, প্রাগাধুনিক যুগে মানুষের পরিচিতি ছিল স্থির ও স্থায়ী, ইচ্ছে করলেই যে কেউ যে কোনও পরিচিতি ধারণ বা নিজেদের উপর আরোপ করতে পারত না। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেকের অবস্থান ও পরিচয় ছিল নির্ধারিত। আধুনিকতার হাত ধরে সামাজিক নাগপাশ শিথিল হলে পরিচিতির স্থৈর্যও আলগা হয়, আর উত্তর-আধুনিকতায় পরিচিতির দোলাচলেই সবাই অভ্যস্ত। বিশ্বায়িত নেটওয়ার্ক সোসাইটি-তে মানুষের দোদুল্যমান পরিচয় একেবারে ভঙ্গুর হয়ে খোলা বাজারে পণ্যের মতো বিকোতে থাকে। টমাস হার্ডির মেয়র অব ক্যাস্টারব্রিজ উপন্যাসে বৌ-বিক্রিকে ভিক্টোরীয় সমাজে মানবতার অবমাননা ধরা হয়েছিল, সত্যজিৎ রায়ের জন অরণ্য ছবিতে সোমনাথ যখন যৌনকর্মীর খোঁজে নিজেরই বন্ধুর বোনকে আবিষ্কার করে, তখন আমরা আধুনিকতায় পরিচিতির টানাপড়েন দেখি। মানবতার মুখ তখনও পর্যন্ত দ্বিধা বোধ করত, পুঁজির কাছে নীতি বিক্রিতে মানুষ ছিল সঙ্কুচিত, লজ্জিত।

প্রযুক্তির দর্শনের দিক দিয়ে লক্ষণীয়, আলোচ্য সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার-এর মৃত্যু কিন্তু এখানে জৈবিক বিনাশ নয়। এটা হল মৃত্যুর ছায়াবাজি। যেমন আমাদের আর প্রয়োজন পড়ে না উল্টো দিকের মানুষটা আসল না নকল সেটা জানার— ডিপ ফেক, মেটাভার্স, হাইপাররিয়েলিটি, এআই চ্যাটবট-এর এই যুগে মানুষের চেয়ে মানুষের অবয়ব, গলার স্বর, কথা বলার ধরন, লেখার শৈলী কত পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুকরণ করা যায়, তার লড়াইয়ে মেতেছে সারা বিশ্ব।

দেকার্তের মন আর শরীরের বিভাজনের ভিত্তিতে আমরা এখন ‘দেহহীন অস্তিত্ব’। নিজের মৃত্যু নিজে ঘোষণা করে, সেই চটকদারিকে আবার সমাজসচেতনতার নাম দেওয়া— এই গোটা ঘটনার মধ্যে আসলে লুকিয়ে সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদে হারিয়ে যেতে বসা মানবতার ‘গুণগত’ চরিত্র। সোশ্যাল মিডিয়ার চরিত্র তা ‘গুণ’-এর চেয়ে ‘পরিমাণ’কে গুরুত্ব দেয় বেশি; হাসি, কান্না, আনন্দ, দুঃখ, ভয় প্রভৃতিকে মাপার প্রয়োজন পড়ে তার। ফলে খোলা বাজারে বাটখারা চাপিয়ে মাপা হয় হাসির দৈর্ঘ্য, কান্নার ওজন। মাধ্যমের সুবিধার্থে করা হয় ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজ়েশন’, একই ভঙ্গি বা ইমোজি-তে সেখানে সবাই কাঁদে।

যত বেশি লোক কাঁদে, অ্যালগরিদম সেই অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ করে। প্রতিক্রিয়াই যেখানে সুখ বা দুঃখ মাপার গজকাঠি, সেখানে যে মৃত্যুর গভীরতা চলে যাবে নিঃশব্দে, পড়ে থাকবে গিমিক, এ তো অবধারিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন