Aadhaar Cards

আধার দিয়ে আঁধারে রাখা

মানুষের হয়রানি কিন্তু কমেনি। কর্তৃপক্ষের বয়ান অনুযায়ী আধার নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র নয়। সরকারের সাম্প্রতিক বয়ান অনুসারে তা জন্মের শংসাপত্রও নয়।

Advertisement

সুমন সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৪ ০৭:৫৯
Share:

— ফাইল চিত্র।

বনগাঁর ঠাকুরনগরের বাসিন্দা সূর্যকান্ত কীর্তনিয়ার বাড়িতে হঠাৎ চিঠি, তাঁর এবং তাঁর পুত্রবধূর আধার বাতিলের। তাতে লেখা, নাগরিকত্বের শর্ত পূরণ করতে পারেননি বলে তাঁদের আধার বাতিল করা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে ২৮এ ধারার। শুধু সূর্যকান্ত নন, রাজ্যের বহু মানুষের কাছে একই চিঠি এসেছে, প্রাপকের সংখ্যা বাড়ছে। সবার একটাই প্রশ্ন, এ বার কী হবে?

Advertisement

১৮২ দিন ভারতে বসবাসকারী এক জন মানুষ আধার পেতে পারেন, এটাই মূল শর্ত। কোনও মানুষ তাঁর হাতের ছাপ, চোখের মণির ছবি এবং অন্য প্রাথমিক পরিচয়পত্র দাখিল করতে পারলে তিনি আধার পেতে পারেন। ২০০৯-এ এই স্বেচ্ছামূলক প্রকল্পটি আনার সময় কংগ্রেস বলেছিল, যাঁদের কোনও পরিচয়পত্র নেই, তাঁদের একটি পরিচয়পত্র দিতেই আধার আনা হল। তখন হিসাব করে দেখা গিয়েছিল, মাত্র ০.০৩ শতাংশ মানুষের কোনও পরিচয়পত্র নেই। সেই থেকে শুরু। ২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পরে, আধার আইন হল। এর পর যে কোনও সরকারি প্রকল্পের সঙ্গে আধার সংযোগ করতে বলে, একটি স্বেচ্ছামূলক প্রকল্পকে কার্যত বাধ্যতামূলক বানিয়ে তোলার প্রক্রিয়া চলেছে এখনও। জীবনের প্রতিটি কাজে আধার লাগছে, শুধু সরকারই নয়, বেসরকারি সংস্থাও মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করছে। শীর্ষ আদালতে মামলা হয়েছে, আদালত রায় দিয়েছে যে শুধু সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্যই আধার দাখিল করতে হবে এক জন মানুষকে; কেউ সেই সুবিধা না নিতে চাইলে তিনি আধার না-ও জমা করতে পারেন।

মানুষের হয়রানি কিন্তু কমেনি। কর্তৃপক্ষের বয়ান অনুযায়ী আধার নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র নয়। সরকারের সাম্প্রতিক বয়ান অনুসারে তা জন্মের শংসাপত্রও নয়। আধার শুধু কোনও মানুষকে চেনার উপকরণ। আধার-রেশন কার্ড সংযুক্ত করতে না পারায় ঝাড়খণ্ডের এক কিশোরীর মৃত্যুর খবর পেয়েও আমাদের মনে হয়নি, আধার বাতিলের দাবিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে চাপ দেওয়া জরুরি। কিছু দিন আগে রেশন কার্ড-আধার সংযোগের ব্যর্থতায় দার্জিলিং জেলার এক চা-বাগান শ্রমিকের মৃত্যুও আমাদের সচেতন করেনি। আমরা বলতে পারিনি, আধার না থাকলে আর তার সঙ্গে সরকারি সুবিধাকে সংযুক্ত না করতে হলে এঁদের মরতে হত না। সম্প্রতি আধারের হাতের ছাপ মিলিয়ে ব্যাঙ্কের টাকা চুরি হওয়ার পরেও আমরা ভাবতে পারছি না সমস্যার গভীরতা। ইদানীং শোনা যাচ্ছে, অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের পিএফ-এর টাকা পেতেও সমস্যা হচ্ছে। আধার নিয়ে আমরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করিনি, ফলে কোনও আওয়াজও ওঠেনি নাগরিক সমাজ থেকে।

Advertisement

কেন্দ্রীয় সরকার যে আমাদের সংগঠিত হতে দেয়নি, গত দশ বছরে তার অন্যতম উদাহরণ আধার। অগণিত মানুষ সরকারের নির্দেশ মেনে আধার সংযোগ করতে ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে ছুটেছেন। কোভিডকালে যে সামাজিক দূরত্বের কথা বলা হয়েছিল, তা আক্ষরিক অর্থে সরকার-বিরোধী যে কোনও লড়াইকে এখন সমাজমাধ্যমে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। গত কয়েক বছরে আধারের অনেক সমালোচনা নাগরিক সমাজ থেকে উঠেছে। আধারের ব্যবহার নিয়ে সতর্কবার্তা আদালতের অঙ্গনেও ধ্বনিত হয়েছে। অথচ, এই আধারই হয়ে উঠেছে নাগরিককে ‘বাদ দেওয়া’র উপকরণ, জালিয়াতি বা নজরদারির মাধ্যম।

আধার নিষ্ক্রিয়করণের খবরে কেন্দ্রের শাসক দলের বাংলার নেতারা নানা কথা বলছেন। কেউ বলছেন প্রযুক্তিগত ত্রুটিতে হয়েছে, কেউ ষড়যন্ত্র দেখছেন, কেউ বলছেন, বিজেপিকে ভোট না দিলে ভবিষ্যতে এ সমস্যা বাড়বে। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আধার নিয়ে প্রাথমিক বিরোধিতা করলেও, পশ্চিমবঙ্গে নানা সরকারি প্রকল্পের সঙ্গে আধার সংযুক্তির নিদান দিয়েছেন। আবার নিজ উদ্যোগে অভিযোগ গ্রহণের সহায়তা কেন্দ্র খুলেছেন; তাতে রাজনীতিটা হলেও ভুল আইনের বিরুদ্ধে ঠিক লড়াই হয় না। যদি তিনি আধারের বিরুদ্ধে একটা লড়াই শুরুর কথা বলতেন, বিষয়টা অন্য মাত্রা পেত, নাগরিক সমাজের একটা অংশ ও বেশ কিছু বিরোধী রাজ্যকে পাশে পেতেন।

অধিকাংশ মানুষ জানেনই না আধারের ২৮এ ধারা কী। এক জন নাগরিকের কি সরকারি এত নিয়মকানুন জানা সম্ভব? বয়স্ক মানুষ, রোজ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করা মানুষ, যাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট-প্যান কার্ড আছে, যাঁরা নিয়মিত সরকারকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর দেন, যাঁরা ভোট দিয়ে শাসক নির্বাচন করেন, তাঁদের কি জানা প্রয়োজন, কেন তাঁর আধার বাতিল হল? না কি তাঁর অধিকার তিনি এই দেশের নাগরিক, এই গোড়ার কথাটাই জোর দিয়ে বলার? মহাত্মা গান্ধী ১৯০৮-এ দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের জন্য তৈরি করা একটি পরিচয়পত্রের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। আজকের সময়টা জটিলতর, তবু সেই লড়াইয়ের উদাহরণ সর্বোচ্চ আদালতে আধারের শুনানির সময় দেওয়া হয়েছিল। ভবিষ্যতে কী হবে তা সময় বলবে, কিন্তু আধার কর্তৃপক্ষ বা সরকারের কি এ বিষয়ে নাগরিকদের নিশ্চয়তা প্রদানই কর্তব্য নয়? নাগরিকদের হেনস্থা করাই কি নাগরিকদের দ্বারা নির্বাচিত শাসকের কাজ?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন