Max Müller

ভারতের বন্দনা, সমালোচনাও

ম্যাক্স ম্যুলারই প্রথম, কারও সাহায্য না নিয়ে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পর বছর পরিশ্রমে ঋগ্বেদের শত শত প্রার্থনা-মন্ত্র-কবিতা সঙ্কলন করেন ও বৈদিক সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।

Advertisement

শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩৩
Share:

ফ্রিডরিশ ম্যাক্স ম্যুলার। —ফাইল চিত্র।

কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্‌-এর প্রবল অনুরাগী মহাকবি গোয়টের সুযোগ্য উত্তরসূরি, জার্মান রোম্যান্টিক কবি হাইনরিশ হাইনে-ও আমাদের প্রাচীন সাহিত্যের বিদগ্ধ পাঠক ছিলেন। রামায়ণ ছিল তাঁর প্রিয়তম গ্রন্থগুলির অন্যতম, তিনি নিজেকে ভারতের নিবিড় অরণ্যের অধিবাসী বলে মনে করতেন। দয়িতার উদ্দেশে লিখেছিলেন, “ছেড়ে চলে এসো বালি ভরা বার্লিন।... ভারতে চলো, রৌদ্রদীপ্ত দেশ।” এই দুই অবিস্মরণীয় কবির মতো, অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বহু জার্মান দার্শনিক, চিন্তাবিদ ও ভাষাবিদ এ এল ব্যাশাম বর্ণিত দি ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ় ইন্ডিয়া-র প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন। প্রাচীন ধ্রুপদী ভারতের দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র হয়ে ওঠে তাঁদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের বিষয়। ফ্রিডরিশ শ্লেগেল থেকে শুরু করে আর্থার শোপেনহাওয়ার— অনেকের সম্মিলিত অবদানকে কেন্দ্র করে জার্মানিতে গড়ে ওঠে ইন্ডোলজি বা ভারততত্ত্বের গরিমাময় ঐতিহ্য। মহাপণ্ডিত ফ্রিডরিশ ম্যাক্স ম্যুলার (ছবি)— যাঁর দ্বিশতজন্মবর্ষ আমরা উদ্‌যাপন করছি— তিনি এই সুগভীর অধ্যয়ন-পরম্পরারই বিশিষ্ট প্রতিনিধি।

Advertisement

শুধু বিশিষ্ট বলা ঠিক হবে না, সর্বার্থে অদ্বিতীয়। কারণ ম্যাক্স ম্যুলারই প্রথম, কারও সাহায্য না নিয়ে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পর বছর পরিশ্রমে ঋগ্বেদের শত শত প্রার্থনা-মন্ত্র-কবিতা সঙ্কলন করেন ও বৈদিক সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। তাঁর এই কীর্তি স্বামী বিবেকানন্দ-সহ অন্য অনেককে স্তম্ভিত করেছিল। রাধাকান্ত দেব তাঁর অবদানকে বলেন ‘নোবল অ্যান্ড এক্সেলেন্ট’। প্রাচীন ভারতের বহুমুখী বিকাশ ও সম্পদকে স্মরণ করে ম্যাক্স ম্যুলার বলেছিলেন, “আই পয়েন্ট টুয়ার্ডস ইন্ডিয়া।”

অতীতের মুখর বন্দনাতেই কি ম্যাক্স ম্যুলারের ভারত-দর্শন সমাপ্ত? না। আদ্যন্ত আধুনিক, প্রখর যুক্তিবাদী ও সমাজসচেতন, দিনানুদৈনিক বাস্তবের প্রতি মনোযোগী, ইমানুয়েল কান্ট ও তাঁর ‘এনলাইটনমেন্ট’ বা আলোকময়তার মন্ত্রশিষ্য ম্যাক্স ম্যুলার তৎকালীন ভারতীয় সমাজের অনাচার দুরাচারকে তীব্র কশাঘাত করেছিলেন। এ যেন অন্য, বিপরীত এক ম্যাক্স ম্যুলার। ঊনবিংশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে তিনি নিবিড় ভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর অকৃত্রিম সহযোদ্ধাদের নাম কেশবচন্দ্র সেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামতনু লাহিড়ী এবং বাংলার বাইরে বেহারামজি মালাবারি ও রমাবাইয়ের মতো নির্ভীক, আপসহীন মানুষ, যাঁরা বাল্যবিবাহ থেকে সতীদাহ নির্মূলে অঙ্গীকারবদ্ধ।

Advertisement

রমাবাই সম্পর্কে তিনি বলেন, “তিনি দারুণ সাহসী মহিলা। কোনও দুর্ভাগ্য বা হুমকি তাঁকে তাঁর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করবে না।” বাল্যবিবাহের বিরোধী মালাবারিকে চিঠিতে উৎসাহ দেন: “আমি আশা করছি আপনি যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করেননি... প্রাচীন, প্রতিষ্ঠিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যে কোনও যুদ্ধে পরাজয় প্রথমে অবধারিত, কিন্তু এই পরাজয় চূড়ান্ত বিজয়েরই পূর্বসূরি।” গুণমুগ্ধ রক্ষণশীল রাধাকান্ত দেবকেও তিনি রেয়াত করেননি। সতীদাহের প্রশ্নে তাঁকে নস্যাৎ করে ম্যাক্স ম্যুলার প্রমাণ করেন, হিন্দুশাস্ত্রে কোথাও সতীদাহের সমর্থন খুঁজে পাওয়া যায় না। তুমুল বিতর্কের পর্বে তিনি দাবি করেন, “আমি গৃহসূত্র থেকে বিপরীত প্রমাণ পেশ করছি।” এথিক্স বা সুনীতির প্রতি দায়বদ্ধ, যুক্তিময়তার প্রতি নিবেদিত এই সুপণ্ডিত রামমোহন রায়কে অভিবাদন জানিয়েছিলেন পথপ্রদর্শক হিসাবে। তাঁর ভাষায় রামমোহন ‘স্বার্থহীন, সাহসী এবং সৎ মানুষ’। তাই বিস্ময় জাগে না, যখন উনিশ শতকের অন্য জ্যোতিষ্কদের মতো তিনিও ভারতে পাশ্চাত্যশিক্ষার প্রসারের জোরালো সওয়াল করেন। ১৮২৩-এ রামমোহন রায় লর্ড আমহার্স্টকে অনুরোধ করেন, আগামী ত্রিশ বছর শিক্ষা বাবদ সমস্ত অর্থ পাশ্চাত্যশিক্ষা বিস্তারে ব্যয় করতে। এই প্রস্তাব পেশের প্রায় তিন দশক পর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সচেষ্ট হন সংস্কৃত কলেজে জেরেমি বেনথাম ও জন স্টুয়ার্ট মিল-এর রচনা পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে। এঁদের অভীষ্ট ছিল ‘এক নতুন জাতীয় সাহিত্য’ সৃষ্টি যা পাশ্চাত্যচিন্তার প্রভাবে সমৃদ্ধ এবং একই সঙ্গে প্রকৃত, অগ্রমুখী ভারতীয়তার প্রতি দায়বদ্ধ। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ম্যাক্স ম্যুলার ও রবীন্দ্রনাথ এক অভিন্ন শিক্ষাদর্শন বা ‘এপিস্টেমোলজি’-র একনিষ্ঠ প্রবক্তা, দাবি করা যেতেই পারে।

তাঁর সারা জীবনের আধার ঋগ্বেদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি কী ভাবতেন? ঋগ্বেদের অতুলনীয় কাব্যময়তাকে তিনি সেলাম জানিয়েছিলেন মুক্তকণ্ঠে, কিন্তু বর্তমান সমাজে তার ব্যবহারিক প্রাসঙ্গিকতা ও উপকারিতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন দ্বিধাহীন ভাবে। বিশ্বের সমস্ত সত্য সন্নিহিত চতুর্বেদে, এই দাবি তাঁর কাছে আজগুবি মনে হয়েছিল। দয়ানন্দ সরস্বতীর অন্ধ বেদপ্রেম তাঁকে প্ররোচিত করে এক ক্ষুব্ধ বিশেষণ প্রয়োগে: ‘পারভার্স’, অর্থাৎ বিকৃত ও বিপজ্জনক। যে বিশ্বচর্চায় তিনি সারা জীবন নিমগ্ন ছিলেন, সেই বেদমন্ত্রগুলিকেই তিনি বলেছিলেন ‘জীর্ণ ও সেকেলে’। তাঁর মতানুসারে, “আমাদের মিউজ়িয়মে এগুলিকে সম্মানের স্থান দিতে আমরা রাজি, কিন্তু এগুলির দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কোনও অবকাশই নেই।” তাঁর এই প্রখর মূল্যায়ন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার মোক্ষম বিচার স্মরণে আনে; ‘ব্যাদে সব আছে’ এই মূঢ় মত্ততার আধিপত্যের বিরুদ্ধে যিনি বলেছিলেন, এ বিশ্বাস শুধু অর্থহীন নয়, বিপজ্জনক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন