Patriarchal Society

বিনোদনে মুক্তির উড়ান

যে কোনও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মতোই পাকিস্তানেও মেয়েদের একটা ‘বস্তু’ হিসাবে দেখা হয়। সেই ‘বস্তু’টির উপর নিয়ন্ত্রণই পুরুষতন্ত্রের পরিচয়।

Advertisement

মালিনী ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:১৩
Share:

—ফাইল চিত্র।

দেশের অর্থনীতিতে মেয়েদের অবদান, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের নিরাপত্তা— এমন বিষয় নিয়ে আলোচনায় পালন করা হল ২০২৩ সালের ‘জাতীয় মহিলা কর্মী দিবস’। ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর ২২ ডিসেম্বর পালন করা হয় দিনটি। ভারতে নয়, পড়শি দেশ পাকিস্তানে। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য কোনও দেশে মহিলা-কর্মীদের জন্য আলাদা করে একটি দিন ধার্য করা হয়নি। পাকিস্তানে এই দিনটিকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার কারণ বোঝা কঠিন নয়। সে দেশে ২০২৩ সালে মহিলা শ্রমশক্তির মাত্র ২২ শতাংশ দেশের অর্থনীতিতে যোগদান করে। মাত্র চার শতাংশ মহিলা ব্যবসায় উদ্যোগী হয়েছেন, যা বিশ্বে সর্বনিম্ন।

Advertisement

ভারতের অবস্থান কি এ বিষয়ে খুব আলাদা? এ দেশের সরকার গত বছর শ্রমশক্তির সমীক্ষায় দেখিয়েছে, কাজের বাজারে নিযুক্ত মেয়েদের অনুপাত (লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন) বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৩৭ শতাংশে। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছেন, এই ‘রোজগেরে’ মেয়েদের একটা বড় অংশই বস্তুত মজুরিহীন শ্রম দিচ্ছেন পারিবারিক পেশায়। তাঁদের ‘স্বনিযুক্ত’ বলে দেখানো হলেও, আসলে তাঁরা আয়হীন। এই মেয়েদের বাদ দিলে ভারতে রোজগেরে মেয়েদের অনুপাত ২০ শতাংশেরও নীচে নেমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা।

অতএব মহিলা-কর্মীদের প্রকৃত পরিস্থিতি কী, তা খতিয়ে দেখার জন্য একটি দিবস ধার্য করার পিছনে যুক্তি রয়েছে যথেষ্ট। ভারত আর পাকিস্তান, দু’টি দেশেই যে-হেতু পুরুষতন্ত্র প্রবল, তাই মেয়েদের দশা অনেকটাই এক। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তার সাক্ষ্য মেলে। মেয়েদের স্বনির্ভরতা, মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার লড়াইয়ের কাহিনি নিয়ে তৈরি পাক সিরিয়ালগুলি ভারতেও খুব জনপ্রিয়। তা সে এক দশক আগে জ়িন্দেগি গুলজ়ার হ্যায়-ই হোক, বা অতি সাম্প্রতিক সিনফ-এ-আহান বা রাজ়িয়া। ‘চাদর অউর চার দিওয়ারি’, অর্থাৎ মুখ-ঢাকা কাপড় আর চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি মেয়েদের মুক্তির খোঁজের গল্প পাকিস্তানি ধারাবাহিকে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। কারণ, চার দেওয়ালের বাইরে বেরোতে না পারার ইচ্ছে বাস্তবে পূরণ করতে না পারা। নাচার মেয়েরা ধারাবাহিকের মহিলা চরিত্রের মধ্যেই খুঁজে নিতে চান নিজেকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মুখ্য চরিত্র হয় মেয়েরা, পাকিস্তানের সিরিজ়গুলির নির্দেশনা, নির্মাণেও থাকেন তাঁরা।

Advertisement

তবে প্রায় যে কোনও দেশের সিরিয়ালের মতোই, পাক সিরিয়ালও পুরুষতন্ত্রের অন্যায্যতা স্পর্শ করেই ক্ষান্ত হয়, তাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করে না। জ়িন্দেগি গুলজ়ার হ্যায় (২০১২) দেখিয়েছে, মুখ্য নারীচরিত্র আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হলেও রক্ষণশীল। তুলনায় উদার নারী চরিত্রগুলিকেও শেষ পর্যন্ত পুরুষতন্ত্রকেই আঁকড়ে ধরতে দেখি। ২০২২-২৩ সালে এসেও বদলায়নি এই ভাবনা। হয়তো তার কারণ, পুরুষতন্ত্রকে ছাপিয়ে সমাজকে বদল করার এক্তিয়ার পাননি পাকিস্তানি মেয়েরা। তাই, ২০২২ সালের সিনফ-এ-আহান (ইস্পাত কন্যা) সিরিয়াল, যা সাত জন তরুণীর পাক সেনায় যোগ দিয়ে মেয়েদের প্রথাগত ভাবমূর্তি ভাঙার গল্প বলে, তাতে লিঙ্গবৈষম্য অত্যন্ত প্রখর ভাবে দেখানো হয়েছে। ২০২৩ সালের ধারাবাহিক রাজ়িয়া-তে মাহিরা খানের মতো জনপ্রিয় অভিনেত্রীকে গল্পের ছলে সামাজিক কপটতা, কন্যাভ্রূণ হত্যা, লিঙ্গবৈষম্য, সম্মানরক্ষার্থে মেয়েদের হত্যা, এ সব সঙ্কটের কথা বলতে হয় জোর গলায়, যাতে সমাজকে সচেতন করা যায়। উচ্চশিক্ষা কী ভাবে মেয়েদের নাগাল থেকে দূরে রয়ে যাচ্ছে, তা পরিসংখ্যান-সহ বলে দিতে হয় মাহিরাকে।

যে কোনও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মতোই পাকিস্তানেও মেয়েদের একটা ‘বস্তু’ হিসাবে দেখা হয়। সেই ‘বস্তু’টির উপর নিয়ন্ত্রণই পুরুষতন্ত্রের পরিচয়। পুরুষ ও মহিলার ক্ষমতায়নের অসম বিন্যাস মেয়েদের আর্থিক স্বনির্ভরতার পথে প্রধান বাধা। সেই সঙ্গে রয়েছে সমাজের নিপীড়নমূলক কাঠামো। চাকরির বাজারেও পুরুষ ও নারীর মধ্যে বৈষম্য চোখে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা লুকিয়ে চাকরির চেষ্টা করেন। আবার দেখা যায়, উচ্চশিক্ষা পাওয়ার আশায় লুকিয়ে পড়াশোনা করতে। গত বছরে পাকিস্তান থেকে অস্কারের জন্য মনোনীত ছবি জয়ল্যান্ড (ছবিতে একটি দৃশ্য)-এও দেখা গিয়েছিল সমাজের তুলে-দেওয়া পাঁচিল ভেঙে সে দেশের মেয়েদের বেরিয়ে আসার স্বপ্ন দেখার কাহিনি। এমন ছবি বার বার আসে পাকিস্তানের টেলিভিশন ও ওয়েব সিরিজ়ের পর্দায়। বাস্তবের প্রতিফলন বলেই সেগুলি এত জনপ্রিয়, সীমান্ত পেরিয়েও। কলকাতার ‘নন্দন’-এ ২০২২-এর ফিল্ম উৎসবে প্রেক্ষাগৃহ ভরে যাওয়ার পর মেঝেতে বসে জয়ল্যান্ড দেখেছিলেন বহু মানুষ।

২০১২ থেকে ২০২৩, এই এক দশকে পাকিস্তানি সমাজে এমন বড় কোনও পরিবর্তন হয়নি, যা মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পথ সুগম করতে পারে। তবে বদল এসেছে পর্দার ধারাবাহিকগুলির গল্পে। আগের থেকে সাহসী হয়েছে মেয়েদের প্রতিবাদের ভাষা। চিরাচরিত সম্পর্কের টানাপড়েন ও পুরুষতন্ত্রের অত্যাচারের বাইরেও নানা ধরনের বিষয় দেখা যাচ্ছে পর্দায়। একে বাস্তবের প্রতিফলন বলা হয়তো ভুল হবে। বরং বলা চলে, এ হল মনের মতো জীবনের জন্য আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ।

রাজ়িয়া-র মতো ধারাবাহিক মনে করিয়ে দেয় যে, অন্য অনেক দেশের থেকে পাকিস্তানের মেয়েরা অনেক পিছিয়ে। তবু একটি বিশেষ দিনে সর্বস্তরের মহিলা-কর্মীদের চাহিদা, দাবি, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের প্রান্তিকতা নিয়ে আলোচনার পরিসর করে দিয়েছে একটি দেশ, সে-ও খুব কম কথা নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন