সাধারণ মানুষের ক্ষোভই জন্ম দেয় প্রতিবাদের নতুন ভাষার
Protest

মুক্তাঙ্গনের রাজনীতি

আবার দিল্লিতে এক তেইশ বছরের তরুণীকে নৃশংস ভাবে ধর্ষণ ও নির্যাতন করে হত্যার ঘটনায় ভারত প্রত্যক্ষ করে আর এক রকমের মুক্তাঙ্গনের রাজনীতি।

Advertisement

সুমন কল্যাণ মৌলিক

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৩ ০৫:৩৯
Share:

লড়াই: গান্ধীমূর্তির পাদদেশে অবস্থান বিক্ষোভের ৭০০ দিন পূর্ণ হয়েছিল ১২ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

কল্লোলিনী কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ময়দানে একটু নজর করলেই দেখা যাবে বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ী তাঁবু, হাতে লেখা পোস্টার আর দাবি-পূরণের দৃপ্ত শপথে উচ্চারিত স্লোগান। সল্ট লেকে, যেখানে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক ভবন রয়েছে, সেখানেও এমন ছবি দেখা যাচ্ছে অহরহ। কোথাও দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে উত্তপ্ত ধর্না মঞ্চ, কোথাও আবার দাবি হাই কোর্টের রায় মেনে বাজারদর অনুযায়ী মহার্ঘ ভাতার। দাবিগুলো নানান ধরনের, তাদের মধ্যে যেমন সাদৃশ্য রয়েছে, তেমনই ভিন্নতাও আছে। কিন্তু দাবি আদায়ের পদ্ধতির মধ্যে মিলটা স্পষ্ট। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার যাবতীয় প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে, সরকারের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে আন্দোলনকারীরা দীর্ঘ সময় ধরে ধর্নামঞ্চ আঁকড়ে বসে আছেন। রিলে অনশন, সহমর্মী গণতান্ত্রিক ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠনের নৈতিক সমর্থন এই ধরনের আন্দোলনের আবশ্যিক উপাদান। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল: এই সংগঠনগুলোর জন্ম এক স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগের পরিণাম হিসাবে। এই আন্দোলন যে শুধু ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে এমনটা নয়, একই সঙ্গে তা প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে থাকা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকেও অস্বীকার করে, গড়ে তুলতে চায় পৃথক রাজনৈতিক পরিসর। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থেই এই উদীয়মান স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগগুলিকে সমর্থন করে; কিন্তু সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা দেখায় যে, আন্দোলন পরিচালনার স্টিয়ারিং আছে নতুন নেতৃত্বের হাতেই। রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণে না থেকে এই নতুন রাজনীতির প্রচেষ্টাই সমাজবিজ্ঞানীদের ভাষায় পলিটিক্স অব স্কোয়্যার বা মুক্তাঙ্গনের রাজনীতি।

Advertisement

বর্তমানে, বিশেষ করে ২০১০-১১ সালের পর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে— স্পেনের বার্সিলোনা ও মাদ্রিদের পুয়ের্তা ডেল সোল থেকে শুরু করে মিশরের তাহরির স্কোয়্যার, নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন হয়ে লিবিয়ার বেনগাজ়ি— মুক্তাঙ্গনের রাজনীতির নানান অভিব্যক্তি নজরে পড়ছে। এর লক্ষণ প্রথম স্পষ্ট হয় তাহরির স্কোয়্যারে, যেখানে কায়রো শহরের জনসাধারণ একজোট হয়ে দীর্ঘ দিনের কঠোর শাসক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের অপসারণ দাবি করেছিলেন। তার ঠিক আগেই ২০১০ সালের ডিসেম্বরে দেখা গিয়েছিল যে, টিউনিজ়িয়ার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে অত্যাচারী শাসক বেন আলির বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। টিউনিস শহরের বহু নাগরিক সে দিন স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে রাজপথে নেমে প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। এক ফেরিওয়ালার গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা টিউনিজ়িয়ার অধিবাসীদের মনে নিষ্ঠুর স্বৈরাচার, নির্যাতন এবং আর্থিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভের বারুদে অগ্নিসংযোগের কাজ করে। প্রাথমিক ভাবে এত দিন ধরে কোণঠাসা রাজনৈতিক দলগুলির প্রচেষ্টায় প্রতিবাদ শুরু হলেও ক্রমশই আন্দোলন নিজস্ব গতি অর্জন করে, এবং বহু অরাজনৈতিক মানুষও পথে নামেন।

আবার দিল্লিতে এক তেইশ বছরের তরুণীকে নৃশংস ভাবে ধর্ষণ ও নির্যাতন করে হত্যার ঘটনায় ভারত প্রত্যক্ষ করে আর এক রকমের মুক্তাঙ্গনের রাজনীতি। নির্ভয়া কাণ্ডে দিল্লির জনগণ কোনও রকম সংগঠিত প্রচেষ্টা ছাড়াই নিজেদের বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ইন্ডিয়া গেটের প্রাঙ্গণে জড়ো হয়েছিলেন। সেই সব মানুষের রাজনৈতিক বিক্ষোভ-সমাবেশে যোগ দেওয়ার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা বা তালিম ছিল না; তা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলির পক্ষে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করা সহজ হয়নি।

Advertisement

এই রাজনীতির আর একটি বৈশিষ্ট্য হল: নাগরিকদের জন্য মুক্তাঙ্গন বা পাবলিক স্কোয়্যারগুলিতে জনসাধারণের মধ্যে বিভিন্ন উপায়ে নানা মত বা সংবাদের আদান-প্রদান ঘটতে থাকে। উচ্চতর স্তর থেকে এই মতামত বা যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোনও রকম নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা স্কোয়্যার রাজনীতি ও জন-জমায়েতের মূল মেজাজ ও ক্রমবিকাশের পরিপন্থী।

কোনও রাজনীতিই স্বয়ম্ভু হতে পারে না। তাই নিকট অতীতে এই রাজনীতির উদাহরণ মেলে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি হোয়াইট হাউসের পার্শ্ববর্তী লাফায়েত স্কোয়্যার পার্ক সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে, কারণ ভিয়েতনাম যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলনকারীরা এখানে জড়ো হয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বাসভবনকে কার্যত অবরোধ করে রাখেন। সেই জমায়েতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত হল যখন ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে বিধ্বস্ত প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এক রাতে আমেরিকান সিক্রেট সার্ভিসের প্রহরা এড়িয়ে রাস্তা পার হয়ে সরাসরি বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে আসেন। ক্রমাগত সমালোচনায় জর্জরিত এক জন প্রেসিডেন্ট প্রতিবাদী যুবকদের সঙ্গে আলোচনা করতে আসছেন— সহজে ভুলতে না পারা এ ছবি যেন পতনোন্মুখ সরকারেরই প্রতীক।

মুক্তাঙ্গনের রাজনীতির আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকে তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারের ঘটনার উল্লেখ না করলে। ১৯৮৯ সালে চিনের রাজধানী বেজিং-এর তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির কঠোর দমনমূলক ব্যবস্থাদি প্রত্যাহার, আরও বেশি স্বাধীনতা এবং প্রশাসনে আরও বেশি স্বচ্ছতার দাবিতে বিক্ষোভ সারা পৃথিবীর নজর কেড়েছিল।

ভোলা যাবে না, ২০১১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ ধ্বনি তুলে আমেরিকার জনতার জুকোত্তি পার্কে গণ অবস্থানের কথাও। সেই আন্দোলন শুধু আমেরিকান অর্থনীতির সর্বগ্রাসী রূপটিকে উন্মোচন করেনি, সামাজিক বৈষম্যের শিকার বিপুল মানুষ সাম্রাজ্যের হৃৎপিণ্ডে তৈরি করেছিল এক নতুন কল্পনা, এক নতুন রাজনৈতিক ভাষা। সেই জনকল্লোল প্রশ্ন তুলেছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন-নির্ভর বিদেশ নীতি নিয়ে। ভোগবাদ, ব্যক্তিগত সুখ ও তৃপ্তির যে মডেল ছিল আদর্শ আমেরিকান জীবনের প্রতীক, তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল এই আন্দোলনের অভিঘাতে।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনগুলি কি তাদের দাবি অর্জন করতে সমর্থ হয়? আরব বসন্তের পর সত্যিই কি পশ্চিম এশিয়ায় গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, না কি নির্ভয়া কাণ্ডের বিরুদ্ধে জাগ্রত গণরোষ এ দেশে নারীদের নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করতে পেরেছে? এক কথায় এর উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা দিল্লির রাজপথে কৃষকদের অবস্থান সরকারকে বাধ্য করেছে নয়া কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে। এ রাজ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থান বাধ্য করেছিল সরকারকে নড়ে বসতে। কিন্তু প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোর প্রতি চরম অবিশ্বাসের এই সময়ে মুক্তাঙ্গনের রাজনীতি যে থাকতে এসেছে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন